এক বছরের কাজ ৫ বছরেও শেষ হয় নি, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও অরক্ষিত

সুব্রত দাশ খোকন, শাল্লা

এক বছর মেয়াদের ভবন নির্মাণের কাজ ৫ বছরেও শেষ হয় নি। শাল্লা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের এই দশা। মুজিববর্ষে কিংবা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে মুক্তিযোদ্ধারা এই ভবনে ঢুকতে পারবেন কী-না এই প্রশ্ন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। ভবনের মূল ফটকটি এখনো নির্মিত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও অরক্ষিত রয়েছে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাবেক দায়িত্বশীলগণ এবং স্থানীয় এলজিইডি’র দায়িত্বশীলরা জানান, দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে শাল্লা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’ এর ভবন নির্মাণের কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ। এক কোটি ৯২ লাখ ৯৩ হাজার ৫২৪ টাকা ব্যয়ে এক বছরে কাজ শেষ করে ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ ভবন বুঝিয়ে দেবার চুক্তিপত্র করে সিলেটের মো. জামান চৌধুরী’র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আক্তার ট্রেডার্স।
দুই দফা কাজ সমাপ্তির তারিখ বাড়িয়েও ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারে নি ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে কাজ বন্ধ থাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই ভবন মুজিববর্ষে কিংবা স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে হস্তান্তরে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
এই কমপ্লেক্সটি নিয়ে ২০১৮ সালেও সুনামগঞ্জের খবরে “দুই বছরেও শেষ হয়নি ভবন নির্মাণের কাজ” শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
তখনকার সুনামগঞ্জের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল আহমেদ সুনামগঞ্জের খবরকে বলেছিলেন বিলম্বের কারণে ঠিকাদারের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে এবং প্রকল্প পরিচালকের অনুমতি নিয়ে নতুন ভাবে টেন্ডার দিয়ে বাকী কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করা হবে।
কিন্তু সোমবার সরজমিনে ভবনটির বাউন্ডারীর ভিতরে ঢুকতেই নাকে লাগে উদ্ভট গন্ধ। ভবনটির বাউন্ডারীর মূল গেইট না থাকায় বাজারে আগত লোকদের এবং বাজার ব্যবসায়ীদের বাউন্ডারীর ভিতরের পূর্বদিকে প্রস্রাব করার নির্ধারিত স্থান হয়েছে। বাউন্ডারীর পশ্চিম দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি অরক্ষিত থাকায় কে বা কারা ভাস্কর্যটির নাকের কিছু অংশ এবং নিচের কয়েকটি অংশে ক্ষতচিহৃ দিয়েও রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধা প্রেমবাঁশী দাসের সাহায্যে ভবনটির মূল কেচি গেইটের তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, ভবনটির সিঁড়ির টাইলস, বাথরুমের ফ্লোরের টাইলস, দরজা, স্যানেটারি ফিটিং, প্রতিটি রুমের শাটার, বৈদ্যুতিক ফ্যান, বাতি, টিউবওয়েল, ভাস্কর্যের নিচের টাইলস, ভবনের চর্তুদিকের বাউন্ডারীর রং ও বাউন্ডারীর মূল গেইট সহ প্রায় ২০ শতাংশ কাজ এখনো বাকী।
মুক্তিযোদ্ধা প্রেমবাঁশী দাস, জগদীশ সরকার, অনিল চন্দ্র দাস, জ্যোতিষ চন্দ্র ভৌমিক, রাকেশ দাস, বলরাম দাস, ধনঞ্জয় সরকার, সুরেন্দ্র চন্দ্র দাস ও সুরেশ দাস ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল মুজিববর্ষে ভবনটি আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়কে ভবনটির ব্যাপারে বলেছি। উনারা শুধু আশ্বস্ত করেই যাচ্ছেন, কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। আন্দোলনে নামা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না আমরা। মূল গেইট না হওয়ায় কিছুদিন পূর্বে কে বা কারা ভাস্কর্যটির বিভিন্ন অংশে স্পট তৈরি করেছে। উপজেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।
শাল্লা উপজেলা এলজিইডি’র ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান বলেন, চাহিদার তুলনায় কাজ বেশী হয়েছে, ঠিকাদারের কিছু বিল আটকা আছে। সময় মতো কাজ শেষ না করার কারণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল ও নতুন কার্যাদেশ চেয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করা হয়েছে।
এলজিইডি’র সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, শাল্লা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’এর কাজ ২-৩ শতাংশ বাকী আছে, কাজের ঠিকাদারকে বার বার তাগাদা দেওয়া হয়েছে, মঙ্গলবারও তাঁর সঙ্গে কঠোরভাবে কথা বলা হয়েছে। কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বাকী কাজ সমাপ্ত করার ওয়াদা করেছে ঠিকাদার। না করলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শাল্লা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ বলেন, দীর্ঘ পাঁচ বছরেও শাল্লা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সটির কাজ সমাপ্ত না হওয়া খুবই দু:খজনক। আমি আগামী জেলা সমন্বয় সভায় বিষয়টি উত্থাপন করব।
প্রসঙ্গত. সিলেটের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আক্তার ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে শাল্লা উপজেলায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ নিয়ে গেল বছরের অক্টোবর মাসে অনিয়মের সংবাদ ছাপা হয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করেও এই সংবাদের সত্যতা পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৮ সালে কাজ অর্ধেক বাকী রেখেই প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে ওই ভবনের উদ্বোধন করানো হয়েছিল। এ নিয়ে সমকালে সংবাদ প্রকাশ হলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাজেট) মো. মমতাজ উদ্দিন এনডিসি গেল বছরের ৮ অক্টোবর সরেজমিনে শাল্লায় তদন্ত করতে আসেন এবং এই প্রতারণার সত্যতাও পান। তদন্ত শেষে ওইদিন বিকালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাজেট) মো: মমতাজ উদ্দিন এনডিসি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ২০ শতাংশ কাজ বাকী রেখেই প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে মাধ্যমে এটির উদ্বোধন করা হয়েছিল।ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আক্তার ট্রেডার্সের যে মুঠোফোন নম্বরটি স্থানীয় এলজিইডি থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। সেই নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও ফোন রিসিভ না করায় কথা বলা যায় নি।