ক্রসফায়ার নয়, বিচার ব্যবস্থার সংস্কারই সমাধান – অ্যাডভোকেট শিশির মনির

‘‘গ্রেফতারের পর আসামীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আসামীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যায় পুলিশ। সেখানে আগে থেকে ওঁৎপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়লে পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। গুলিবিনিময়ের এক পর্যায়ে গ্রেফতারকৃত আসামী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ,….. উদ্ধার করেন।’’ এক দশকের অধিক সময় ধরে প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের পর সংবাদ মাধ্যমে পুলিশের এই বিবৃতি নাগরিকদের কাছে অতি পরিচিত। দাঁড়ি কমাবিহীন এই বিবৃতি প্রদান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত এক দশকে অন্তত দুই সহস্রাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে উত্থাপিত হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২০৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী কতৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের নজীর বহু পুরোনো। ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারী পূর্ববাংলা সর্বহারা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতা শিরাজ শিকদারকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২ জানুয়ারী রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে সাভারের তালবাগ এলাকায় গুলি করে হত্যা করে। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্রসফায়ারের ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। (৪ জানুয়ারী ১৯৭৫, ইত্তেফাক)
২০০২ সালের ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ এর মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর সরকারের আদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এই ‘সন্ত্রাস নির্মূল’ অভিযান চলে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারী পর্যন্ত। ৮৫ দিনের এই অভিযানে নিহত হয় অন্তত ৪৬ জন। সস্ত্রাস দমনের লক্ষে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ পুলিশ বাহিনীর অধীনে এলিট ফোর্স ‘র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটলিয়ন’ (র‌্যাব) গঠন করে সরকার। পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যেদের সমন্বয়ে এটি একটি চৌকস বাহিনী। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য র‌্যাবকে নিয়ে সমালোচনা চলে আসছে। র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে তৎকালীন আইনমন্ত্রী বলেন ‘র‌্যাবের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের মৃত্যু হলে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না, কারণ আত্নরক্ষার জন্য র‌্যাব গুলি ছোঁড়ে’। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী র‌্যাবের সমালোচনা করে ‘সরকার র‌্যাবকে মানুষ খুন করার লাইসেন্স দিয়েছেন’ মর্মে মন্তব্য করেন। (২৩ জুলাই ২০০৪, দৈনিক সংবাদ)। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০১- ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ১১৯৯। পরবর্তী ১/১১ এর সেনা সমর্থিত সরকারের ২ বছরে (২০০৭-২০০৮) এই সংখ্যা ৩৩৩ এ দাঁড়ায়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ’ এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০০৯ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ কর্তৃক দায়েরকৃত রিটের শুনানীতে সরকার পক্ষ থেকে ‘আর কোন ক্রসফায়ার করা হবে না’ মর্মে আদালতকে অভিহিত করেন। একই বছরের ফেব্রুয়ারীতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে সরকার ক্রসফায়ার হত্যার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ অঙ্গীকার করে।
এতসব প্রতিশ্রুতি ও আইনী সমালোচনার পরেও, ক্ষমতা গ্রহনের প্রথম ৯ মাসে পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে ১০০ জনের অধিক প্রাণ হারায় । তন্মধ্যে বিডিয়ার বিদ্রোহে আটক ৪০ জন বিডিয়ার সদস্যের মৃত্যু উল্লেখযোয্য। (১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯, প্রথম আলো)। ‘অধিকার’ এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০২০ (জুন) সাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ২৪৭০ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সমীক্ষা অনুযায়ী শুধুমাত্র চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৯৬ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
২০১৮ সালের মে মাসে সরকার ঘোষিত মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করার পর ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ নামক শব্দ ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় ৫ (পাঁচ) শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। সবচেয়ে বেশি নিহত হয় মাদকের প্রবেশপথখ্যাত কক্সবাজারের টেকনাফে। এই জেলায় ক্রসফায়ারে সর্বমোট মৃতের সংখ্যা ২৩০।
সম্প্রতি ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ রোডে সিনহা মো: রাশেদ নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারকে (মেজর) গুলি করে হত্যা করে টেকনাফ পুলিশ। মামলার নথিতে পুলিশ তার বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। গণমাধ্যমের কল্যাণে বেরিয়ে আসতে থাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টেকনাফ পুলিশের নজীরবিহীন ভয়াবহ অপরাধের চিত্র। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত আলোচিত ওসি প্রদীপ দাসের নেতৃত্বে গত ২২ মাসে মোট ১৪৪ টি কথিত ক্রসফায়ারে ২০৪ জন কে হত্যা করা হয়। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী নিজের পদকে কাজে লাগিয়ে ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক চোরাচালান, নিজস্ব টর্চার সেলে নির্যাতন, অন্যের জমি দখল সহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল প্রদীপ কুমার। শুধু প্রদীপ নয়, সারাদেশেই নানা ধরনের ফৌজদারী অপরাধের সাথে পুলিশের সম্পৃক্ততার খবর পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগের কমতি নেই। ২০১৪ সালে নারায়নঞ্জে র‌্যাব কর্তৃক আলোচিত সেভেন মার্ডারের (অপহরণ ও হত্যা) পর প্রচন্ড সমালোচনার মুখে পরে বাহিনীটি। র‌্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সরকারই বাহিনীটি বিলুপ্তির দাবী তোলে।
সংবিধান, আইন, আদালত ও প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে প্রতিটি সরকার কেন মদদ দিচ্ছে? বিচার বহির্ভূত হত্যার বিচার হয়না কেন? হত্যা নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কেন মানা হয় না? আইনপ্রণেতারাই কেন আইনী প্রক্রিয়ায় বিচারের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না?
শিরাজ শিকদারকে হত্যার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচারবহির্ভূত হত্যার যেই মিছিল শুরু হয়েছিল তা এখনো বিদ্যমান। এই হত্যাকান্ড নিয়ে সে সময়ে সমালোচনা হলেও গর্হিত ও আইন বহির্ভূত এই হত্যার বিচার আজও পাওয়া যায়নি। ২০০২ সালে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে ‘অপারেশন ক্লিনহার্টে’ নামক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে সম্পৃক্তদের দায়মুক্তি প্রদান করে সরকার ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ (২০০৩ সালের ১ নং আইন) প্রণয়ন করে। আইনটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০১২ সালে করা একটি রিট আবেদনের (রিট পিটিশন নং. ৭৬৫০ অব ২০১২) প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। উক্ত রায়ে মাননীয় আদালত উল্লেখ করেন, “একজন দাগী আসামীরও আদালতে যথাযত আইনী প্রক্রিয়ায় বিচার লাভের অধিকার রয়েছে। তার অপরাধের জন্য যৌথবাহিনী দ্বারা তাকে শারীরিক নির্যাতন অথবা হত্যা করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা যৌথবাহিনী আইন তাদের নিজের হাতে তুলে নিতে পারবে না, এটি সংবিধানের লঙ্ঘন” (৩৭ বিএলডি ২৭১, প্যারা ৩৭)।
২০০৯ সালের ২৯ জুন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট ও কর্মজীবি নারী নামের তিনটি সংস্থার দায়ের করা রিটের প্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং হত্যায় জরিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেন ফৌজদারী ও বিভাগীয় ব্যাবস্থা নেয়া হবে না মর্মে সরকারের নিকট ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। সরকার এখনো পর্যন্ত রুলের জবাব দেয়নি।
শুধু দায়মুক্তিই নয়, বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ফোরাম সংসদে দাঁড়িয়ে খোদ আইন প্রণেতারাই (ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের সংসদ সদস্য) আইন বহির্ভূত ক্রসফায়ারের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন (১৪ জানুয়ারী ২০২০), যা রীতিমত বিস্ময়কর। এখানে একটি প্রশ্ন স্বভাবতই আসে, আইনপ্রণেতারাই বিচার প্রক্রিয়ায় উপর আস্থা রাখতে না পারলে সাধারণ মানুষ কিভাবে অশ^স্ত হবে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী আইনানুগ প্রক্রিয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ক্রসফায়ারের সাজানো এই হত্যা একদিকে যেমন দেশের সর্বোচ্চ আইনের লঙ্ঘন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইনেরও সুস্পষ্ট বিরোধী (অনুচ্ছেদ ২ (১) ও ৪), জাতিসংঘ সনদ)।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় নির্যাতন ও হত্যা রোধ করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে সরকার নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের ধারা ২(৭) অনুযায়ী কোন ব্যক্তি আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হেফাজতে ও আটককালে কেউ মৃত্যুবরণ করলে তা হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভূক্ত হবে। ধারা ৬ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছড়াও তৃতীয় ব্যক্তি তার পক্ষে আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। ধারা ১৫ (২) অনুযায়ী নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর জন্য দোষী ব্যক্তি অন্যূন যাবজ্জীবন অথবা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানের চিত্র অনুযায়ী আইন প্রণয়নের পর আগের বছরগুলোর তুলনায় হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু দুটোই বেড়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো পুলিশ কর্তৃপক্ষ বারবার সরকারের নিকট এই আইনটিকেও বাতিলের দাবী জানিয়ে আসছে।
দেশী বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো শুরু থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা করে আসছে। কিন্তু বিপরীত দিকে প্রত্যেকটি ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটনের পর (গণমাধ্যমে আলোচিত ইস্যুতে) জনসাধারনের পক্ষ থেকে অপরাধীদের ক্রসফায়ারে হত্যার দাবী খুব সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছ। শিশু ধর্ষণ, প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা, মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততার মত অপরাধের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রসফায়ারের দাবী জোরালো হয়। প্রচলিত বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ ঘৃণ্য অপরাধের বিচার হিসেবে আরেক হত্যাকে সমাধান মনে করছে।
মামলা দায়েরে পুলিশের নিকট হেনস্তা, অপরাধীর অনৈতিক প্রভাবে ভিকটিমের অসহায়ত্ব, রুগ্ন তদন্ত ব্যাবস্থা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, রায় প্রদানে অপ্রতুলতা (স্বল্প কনভিকশন রেট), আইনের ফাকফোকরে বেরিয়ে যাওয়া, রায়ে ক্ষমতাবানদের প্রভাব/হস্তক্ষেপ প্রায়শই বিচারিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করছে, যা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অবস্থা এতটাই বেগতিক, আলোচিত ফৌজদারী অপরাধের বিচার সম্পর্কে নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তির (প্রধানমন্ত্রী) আশ^াস দিতে হয়। বিশ^জিৎ, নুসরাত, রিফাত (বরগুণা), আবরার ফাহাদ সহ সকল আলোচিত হত্যাকান্ডের পর সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সরকার থেকে বিচার নিশ্চিতের দৃঢ় আশ^াস প্রদান করা হয়। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আবার ঝিমিয়ে পরে বিচার প্রক্রিয়া। কখনও কখনও ক্ষোভকে প্রশমিত করতে যথাযথ প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল, মব জাস্টিসের আশ্রয় নেয়া হয়। এসব কারণে ধীরে ধীরে বিচার ব্যবস্থার প্রতি নাগরিকদের গভীর আস্থাহীনতা তৈরী হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা গণদাবীতে পরিণত হওয়া তারই ইঙ্গিত বহন করে।
বিচারবহির্ভূত এইসব হত্যাকান্ডের বৈধতার প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর এসব হত্যাকান্ডের পর বরাবরবই জবাবদিহিতার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের কৃত অপরাধসমূহ তদন্ত করার জন্য নাই কোন স্বাধীন সংস্থা। নিজেদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্তভার নিজ বাহিনীর উপড় ন্যাস্ত, ফলে তদন্ত প্রক্রিয়া নানাভাবে প্রভাবিত হয়। এসব জটিলতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে না পারার ফলে বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এমতাবস্থায় এসব বাহিনীর হাতে অপরাধীর বিচারের জন্য ক্রসফায়ার প্রত্যাশার পরিণতি কতটা ভয়ংকর ও ব্যুমেরাং তার কিছুটা দৃশ্যমান হয়েছে মেজর সিনহার হত্যা ঘটনায়।
ক্রসফায়ারে অপরাধীকে বিচারবহির্ভূত হত্যার পরেও কমেনি সংশ্লিষ্ট অপরাধের হার। মাদক বিরোধী অভিযানে পাঁচ শতাধিক মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা গেলেও কমেনি মাদকের সরবারাহ। বরং এই অভিযান কে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অপরাধের তথ্য বেরিয়ে আসছে। সুতরাং একটি অপরাধের বিচারের নামে আরেকটি নতুন ভয়ানক অপরাধকে সমর্থন করা একটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রচলিত বিচারব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও প্রভাবমুক্ত করার মাধ্যমেই অপরাধীর সঠিক বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। ক্রসফায়ারের মত আত্মঘাতী ও বিধ্বংসী মনোভাব থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের সঠিক তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়ার মত স্বধীন তদন্ত কমিশন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কমিশন অভিযোগ গ্রহণ করবে ও অপরাধ তদন্ত শেষে আদালতে রিপোর্ট পেশ করবে। বিচারব্যাবস্থাকে (বিশেষভাবে নিন্ম আদালত) শক্তিশালীকরণই একমাত্র সমাধান।

মোহাম্মদ শিশির মনির
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সাথে
যায়েদ বিন আমজাদ
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়