দুর্ভোগ ঘরে ঘরে

 

 

 

বিশ্বজিৎ রায়
টানা তৃতীয় দফা বন্যায় চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন জেলার বেশির ভাগ মানুষ। অসহায় হয়ে পড়েছেন জেলা শহর, উপজেলা সদর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ। জেলার ছাতক, দোয়ারা, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, বিশ^ম্ভরপুর, তাহিরপুর, জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের অধিকাংশ বসতঘরে পানি। পানিবন্দীরা ঘরে বসেই প্লাবনের সাথে যুদ্ধ করছে। উপর্যপুরী বন্যায় কাজকর্ম হারিয়ে বিপাকে পড়েছে এসব এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ। টানা বন্যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা হয়েছে অধিকাংশ মানুষের। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এসব মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে পানিতে ধসে পড়ছে তাদের ঘরবাড়ি অন্যদিকে গৃহপালিত পশু নিয়ে আছেন মহাবিপদে। এছাড়া মাছভর্তি পুকুর তলিয়ে মারাত্বক ক্ষতির মুখে পড়েছে মাছ চাষীরা। তিন দফা বন্যার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অচল হয়ে পড়েছে জনজীবন। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগিতা না পেলে বন্যা কবলিত এলাকায় দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়। পানি কমছে ধীরগতিতে, বন্যা পরবর্তী দুর্ভোগ আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। বন্যার পানি নতুন নতুন এলাকাও প্লাবিত করছে। ধর্মপাশা, দিরাই ও শাল্লায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
শহরের মানুষেরা আছেন এক ধরণের কষ্টে, গ্রামের মানুষ আরেক ধরণের। হাওর তীরবর্তী প্রান্তিক মানুষেরা আরও বেশি বিপদে আছেন। ঘরবাড়িতে বন্যার নেতিবাচক প্রভাব তো আছেই, এর মধ্যে প্রচ- ঢেউ আর আফালে তচনচ করা বাড়িঘর রক্ষায় তাদেরকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বসতভিটার ওপর আচড়েপড়া ঢেউয়ের ভয়াবহতা ঠেকাতে জীবনঝুঁকি থাকা সত্বেও নৌকা নিয়ে কচুরিপানা সংগ্রহে বের হচ্ছেন হাওরে। বাড়িঘর রক্ষা করতে প্রাণান্তর চেষ্টা। উপজেলা সদর থেকে দূরের বানভাসীরা সহায়তাও পান কম।
ফেনারবাঁক ইউনিয়নের বিনাজোড়া গ্রামের উৎপল পুরকায়স্থ বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা ঢেউ। পানি বাড়লেই ঢেউয়ের ধাক্কায় আমাদের বাড়ি-ঘরে ভাঙন সৃষ্টি হয়। তলিয়ে যায় ঘরবাড়ি। পুরো গ্রামই বন্যা ও ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। ঢেউ থেকে রক্ষা পেতে জারমুনি (কচুরিপানা) ও পাইন্য বনের খোঁজে বের হতে হয় আমাদেরকে। এর মাঝে তিন-তিনবার বন্যায় প্রচ- দুর্ভোগে ফেলে দিয়েছে হাওরাঞ্চলের মানুষকে। এবছর খুবই কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন চলছে আমাদের।’
জামালগঞ্জের নতুনপাড়ার আব্দুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠা ছায়েদ আলী বলেন, ‘বারবার পানি আসায় মাটি চইলা গিয়া ঘরটা ডাইবা গেছে। যার লাগি এই পানিতে ঘরে উড়াত পানি হইছে। দুই দিন আগে যখন স্কুল উঠি তখন রাইত প্রায় ২টা। পানি বাড়তে বাড়তে ঘরও উইঠ্যা গেলে তাড়াতাড়ি বৃষ্টি ও বাতাসের মাঝেই ছোট্ট এই নৌকায় কইরা বৌবাচ্চা নিয়া স্কুলে আশ্রয় নেই। এখন খুব কষ্টের মধ্যে আছি। চারপাশে পানি। সাহায্য ছাড়া আমরার কোন গতি নাই।’
সাচনা বাজারে সদাই করতে আসা বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের রাজিনপুর গ্রামের মো. মাসুক মিয়া বলেন, ‘গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই পানি। আমাদের গ্রামের (রক্তি নদীর তীরবর্তী) বেলডুপ হাঁটির ৪০ টা বাড়ির ৩৫টা ঘরেই পানি ঢুইক্যা গেছে। এর মধ্যে কয়েকটা পরিবার স্কুলে গিয়া উঠছে। বাকিরা গরু-বাছুর নিয়া পানির মধ্যেই কষ্ট কইরা বসবাস করতাছে। এই রকম পরিস্থিতিতে সবারই সরকারি সাহায্য দরকার।’
বেহেলী ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামের মো. হিরন মিয়া বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি পানি, ঘরে ঘরে দুর্ভোগ। বদরপুর গ্রামের নদীর উত্তরপারের হাঁটির অনেক পরিবারই বাড়িঘর ছাড়া। প্রায় সব বাড়িঘরেই পানি। তারা কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে কেউবা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অপরদিকে গ্রামের দক্ষিণের হাঁটিও প্রায় পানিমগ্ন। তবে হালির হাওরের প্রচ- ঢেউ আমাদেরকে জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জারমুনি দিয়ে কোনো রকম জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। বড় কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে আমাদের।’
সাচনা বাজার ইউনিয়নের মফিজনগর গ্রামের মনফর আলী বলেন, ‘এইবার লইয়া তিন তিনবার পানি উঠছে ঘরে। একটা গরু আছিল, এই গরুটা কুকড়াপশী মেয়ের বাড়িতে রাইখ্যা আসছি। ঘরে অনেক পানি ছিল। বালু দিয়া কোনো রকম রান্নার জায়গাটা করছি। মাটির চৌকায় (চুলা) রাইন্দা-খাইয়া বাইচ্যা আছি। গত পানিতে ১ কেজি চিড়া পাইছিলাম। এইডা দিয়া কি জীবন চলে।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত দেব বলেন, ‘এখন পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তারপরও আমরা তৎপর আছি। বন্যার্তদের ভিজিএফ দেওয়া হচ্ছে। দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে।
বিশ^ম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমীর বিশ^াস জানালেন, আমার অফিস ভবনের নীচতলায় পানি। অফিসে ঢুকতে হাটুর উপরে পানি। পানি কমতে শুরু হয়েছে। তবে এবারের তিন দফায় বন্যায় যেটি হয়েছে মাটির সড়ক থেকে পাকা সড়ক, সবই নষ্ট হয়ে গেছে। এবার সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন হাওরপাড়ের গ্রামের মানুষ। তারা বাড়ি-ঘর রক্ষা করা নিয়ে রীতিমত লড়াই করছেন। অনেক জানিয়েছেন, গত ২০-২৫ বছরের মধ্যে হাওরে এতো ঢেউ দেখেননি তারা।
জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগের দুই দফায় বন্যায় পাওয়া সহায়তা বিতরণ চলছে। আবার নতুন করে বৃহস্পতিবার ২০০ মেট্রিকটন চাল ২ লাখ গোখাদ্য, ২ লাখ শিশু খাদ্য, ২০০০ পেকেট শুকনো খাবার এসেছে। এগুলোও উপজেলায় উপজেলায় দ্রুত পাঠানো হবে।