পণ্যের মান নিয়ে ঢাবি শিক্ষকদের গবেষণা প্রতিবেদন বোগাস!

সম্প্রতি দুধ, সফট ড্রিংকস, তেল, পাম অয়েল, ঘি, হলুদ ও গুঁড়া মরিচের মান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ ও বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে চালানো এ পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব পণ্য বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ডসের মান উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। যেখানে দেশীয় বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও স্থান করে নেয়া স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের নাম আসে।

অথচ একই দিন বিএসটিআই এসব কোম্পানির পণ্যে কোনো ধরনের ভেজাল নেই বলে জানায়। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সরকারের নজরে আসে এটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন।

প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ফার্মেসি অনুষদের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের কাছে কাল্পনিক মনে হয়েছে। তাদের দাবি, এত অল্প সময়ে একসঙ্গে এতগুলো পণ্যের নমুনা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে সংসদে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য ওই প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রিপোর্ট (প্রতিবেদন) মিথ্যা।’

সরকার, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অনুষদের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের কাছে প্রতিবেদনটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ঢাবির ওই গবেষক দলের প্রধান, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় পরীক্ষা করা পণ্যের ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট প্রসঙ্গে। তবে তা দিতে বরাবরই অস্বীকৃতি জানান সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠকারী এ গবেষক।

অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের দাবি, ল্যাব রিপোর্ট অন্যের কাছে সরবরাহ করতে আইনি জটিলতা রয়েছে। তিনি তা করতে পারেন না। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো পয়েন্টের কোয়ারি (প্রশ্ন) থাকলে তার উত্তর দিতে তিনি রাজি।

একপর্যায়ে ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট দিয়ে আপনি কী করবেন- এমন প্রশ্ন তুলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আপনি কি কেমিস্ট? রিপোর্টগুলো কোনো কোম্পানি বা কাউকে দেয়ার কথা নয়। আমাদের আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। ইউনিভার্সিটির ফান্ড থেকে এ কাজ করা হয়েছে। আমরা কোনো কোম্পানির হয়ে কাজ করি না।’

ফার্মেসি অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো মূলত ড্রাগের মান পরীক্ষার কাজ করে। খাদ্যের মান নিয়ে নয়। তবে এটা করতে কোনো বাধা নেই। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফার্মেসি অনুষদের বিভাগগুলো ড্রাগ ও ফুড- দুটা বিষয়েই গবেষণা করে। তবে অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে কিছুটা আপত্তি রয়েছে তাদের।

তারা জানান, একটি খাদ্যপণ্যের ল্যাব টেস্টের জন্য যতগুলো কম্পোনেন্ট (উপাদান) থাকা দরকার তার সব আমাদের কাছে নাই। এছাড়া সব সরঞ্জামাদির দেয়া রিপোর্টও যে শতভাগ সঠিক, তাও বলার সুযোগ নাই। কারণ এখানে অনেক মেশিন রয়েছে যেগুলো অনেক পুরনো। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ব্যবহার শেষে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে থাকে, যাতে শিক্ষার্থীরা এসব মেশিনের মাধ্যমে নিজেদের ল্যাবের কাজ সারতে পারে, শিখতে পারে। খাদ্যপণ্যের মান যাচাইয়ের মতো মেশিন এগুলো না- বলেও জানান তারা।

ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, ‘আমরা সচারচার যেসব গবেষণা করে থাকি, তার রিপোর্ট কখনও সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করি না। এটা আমাদের কাজ নয়। আমরা সেগুলো বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করি। এরপর সরকার যদি মনে করে এসব তাদের দরকার, তাহলে তারা আমাদের কাছে আসে। তখন আমরা তাদের কাছে ডাটাগুলো সরবারহ করি।’

‘আমরা কখনও সেগুলো তাদের কাছে গিয়ে দেই না। কিংবা সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকেও জানাই না। যারা এগুলো করে, আমার মনে হয় কোনো একটা বিশাল উদ্দেশ্য থাকে এসবের পেছনে।’

তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আগামী ৩০ জুন রিটায়ারমেন্টে (অবসর) যাচ্ছেন। যার কারণে তিনি এর আগে কিছু একটা করে আলোচনায় থাকতে চাচ্ছেন। আমি এ গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানি না। কাউকে এ কাজ করতে দেখেছি বলেও মনে হয় না।’

অধ্যাপক সীতেশ বলেন, ‘আমি যখন কোনো খাদ্যপণ্যের ওপর রিপোর্ট দিচ্ছি তখন আমাকে অবশ্যই ল্যাবের পাশাপাশি অন্য আরেকটি ল্যাব থেকে এর পরীক্ষা করাতে হবে। সব রিপোর্ট এক হলে তারপর আমি বলতে পারি, এটা ভেজাল। এর আগে নয়। আর তিনি যে সময়ের মধ্যে এ গবেষণা করে রিপোর্ট দিয়েছেন, বাস্তবতার সঙ্গে তা যায় না। কারণ এ ধরনের পরীক্ষায় কয়েক মাস সময় লাগে।’

অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের বিরুদ্ধে এর আগেও পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশের অভিযোগ রয়েছে। তিনি একসময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সাব-কমিটিতে ছিলেন। যেখানে তিনি দেশীয় মেডিসিন কোম্পানিগুলোর মান যাচাই করতে পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে প্রথম সারির একটা কোম্পানিকে ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়। ওই প্রতিবেদনের কারণে অধ্যাপক ফারুককে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি তিরস্কারও করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফার্মেসি অনুষদের এক সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের দেয়া রিপোর্ট (প্রতিবেদন) বোগাস (মিথ্যা)। পুরোটাই কাল্পনিক। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নাই। তিনি তার কয়েকজন স্টুডেন্টকে (ছাত্র) দিয়ে এসব পরীক্ষা চালিয়ে রিপোর্ট দিয়েছেন। যদিও এসব রিপোর্ট দিতে হলে এক্সপার্ট (অভিজ্ঞ) লোক দিয়ে কাজ করাতে হয়।

‘মূলত রিটায়ারমেন্টে (অবসর) যাওয়ার আগে আলোচনায় থাকতে খাদ্যপণ্যের ওপর গবেষণা করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাচ্ছেন। আমি মনে করি, তিনি দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে কোনো একটি মহলের হয়ে কাজ করছেন।’

বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু সারা শামসুর রউফ বলেন, ‘প্রকাশিত প্রতিবেদন আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। আসলে তারা দেশব্যাপী একটা প্যানিক (আতঙ্ক) সৃষ্টির জন্য এটা করেছেন। আমি মনে করি, এজন্য তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক (জীবাণু-প্রতিরোধী) উপাদান আছে, আবার অর্গানিজম গ্রো (জীবের বৃদ্ধি) করছে। বাস্তবতা হলো, অ্যান্টিবায়োটিক থাকলে অর্গানিজম গ্রো করে না। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ালে তো গ্রো (বৃদ্ধি) হয় না। ৯০ ভাগের বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ইউরিনের (প্রস্রাব) সঙ্গে বের হয়ে যায়। কোনো কোনো সময় ৯৯ ভাগই বের হয়ে যায়। কিন্তু তারা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে।’

অধ্যাপক শামসুর রউফ বলেন, ‘এ রিপোর্ট প্রকাশের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে। দেশের মধ্যে একটা প্যানিক সৃষ্টি করা, এর মাধ্যমে কিছু পয়সা কামানোসহ আরও অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমি মনে করি, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য কাজটা করা হয়েছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চান তারা।’

প্রকাশিত প্রতিবেদনের সমালোচনা করে গত বৃহস্পতিবার সংসদে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে তথ্য দিয়েছেন তা আমরা বিশ্বাস করি না। এটা ঠিক নয়।’

তিনি বলেন, আপনারা জানেন গত পরশু বাংলাদেশের কিছু অসৎ ব্যবসায়ী ঢাকা ইউনিভার্সিটির একটি টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে বলছে, মিল্ক ভিটায় আর্সেনিক আছে। মিল্ক ভিটা দুধের মধ্যে নাকি ফরমালিন আছে। এটা সর্বস্ব মিথ্যা কথা।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এটা তো রিসার্চ ফাইন্ডিংস (গবেষণা ফলাফল)। নিঃসন্দেহে এটা দেশ ও জাতির উপকারে আসবে। এটার ফল প্রকাশিত হয়েছে। যদি কেউ গবেষণার ফলকে চ্যালেঞ্জ করে তাহলে পুনরায় গবেষণা হবে। শিক্ষকরা ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করে যেটা পেয়েছেন সেটাই প্রকাশ করছেন। এখানে মন্ত্রী কী বলল, উপাচার্য কী বলল, কিছুই আসে-যায় না।’