হাওরাঞ্চলের চরম অবহেলার শেষ কোথায়

সারোয়ার আহমেদঃ

নদ নদী, হাওর-বাওর বিল-ঝিল, পুকুর-ডোবা নিয়ে গঠিত আমাদের এই বাংলাদেশ। সিলেট বিভাগের চারটি জেলাসহ নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় রয়েছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার হাওর-বাওর, বিল-ঝিল। হাওর বলতে যে ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে তা হলো চারদিকে সাগরের ন্যায় বিস্তীর্ণ জলরাশি। হাওরের নির্মল বাতাস আর সৌন্দর্যে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। কিন্তু হাওর এলাকা দূর থেকে দেখতে যতটা মনোমুগ্ধকর, উদার, বিস্তীর্ণ খোলামেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মনে হয়, কাছ থেকে দেখলে ঠিক ততটাই হাওরপাড়ের জীবনমান অনিশ্চিত ও দুর্বিষহ। এখানকার মানুষ জন্মের পর থেকে দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকে। এই দুর্যোগ কখনো মানবসৃষ্ট, কখনো প্রাকৃতিক।
ধান এবং মাছের জন্য হাওর অঞ্চল একটি উর্বর ক্ষেত্র। ধান এবং মাছের চাহিদা পূরণে যুগে যুগে অবদান রেখে আসছে ভাটি বাংলার মানুষ। অথচ বাংলাদেশের অনেক মানুষ জানে না হাওরবাসীর সুখ-দুঃখ সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। হাওর অঞ্চলে বছরে ছয়-সাত মাস থাকে পানি। বাকি সময় শুকনো। এই শুকনো মওসুমে ফসল চাষাবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় হাওরবাসীকে। তারা বছরে উৎপাদন করে একটি মাত্র ফসল যা দিয়ে চলে তাদের সারা বছর। অথচ মৎস্য চাষ আর কৃষি ভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে এই হাওরাঞ্চলে। অনেকের মতে, হাওরের উৎপাদিত ফসল ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারলে দশ বছরে পাল্টে যাবে দেশের সার্বিক অর্থনীতির চেহারা। দুই কোটির অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে সেভাবে ভাবছে না কোনো সরকারই।
এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগ কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকীরা মৎস্য চাষসহ ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই অঞ্চলে বছরে একটি মাত্র ফসল উৎপাদিত হয়, সেটা হচ্ছে বোরো। বছরে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয় এই অঞ্চলে। একসময় হাওর এলাকার মানুষ শুধু ধান চাষের ওপর নির্ভর করে সারা বছর মহাসুখে দিন কাটাত। কারণ, তখন মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল প্রচুর। এখন সময়ের সাথে পরিবারগুলোর লোকসংখ্যা বাড়তে বাড়তে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে আসছে। তাছাড়া প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল বিনাশ এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুব একটা ছিল না। তাছাড়া ধান চাষের উৎপাদন খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে, এবার প্রতি মণ ধানে কৃষককে ৫০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। সারা দেশেই এ পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক কৃষক ধান ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে ফুরিয়ে দিয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগের কল্যাণে প্রায় সবারই জানা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে হাওর এলাকায় এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বড় ধরনের ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। এতো গায়ে-গতরে খেটে শেষ পর্যন্ত যখন ন্যায্যমূল্য পায় না কৃষক, তাহলে কেন তারা কৃষিকাজ করবে।
হাওর এলাকার কৃষকেরা ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে না পারায় হাওরের কৃষক পরিবারগুলোতে হাহাকার। এবার সারা বছর একটি মাত্র ফসল কোনোভাবে কাটার পর উঠান থেকেই অনেক কৃষক ঋণ পরিশোধে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন ধান। ঘরে যে ধান আছে তাও তারা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারছেন না। নতুন ধান উঠার সাথে সাথে কৃষকরা সংসার খরচ তথা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কম মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অধিক লাভবান হয় এক শ্রেণীর মৌসুমী ফরিয়া বেপারি, আরতদার ও চাল কল মালিকরা যারা ওজনে বেশি মেপেও কৃষককে ঠকিয়ে থাকে। সে মর্মে নতুন ধান উঠার সাথে সাথে ধানের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে সরকারিভাবে ন্যায্য মূল্যে নতুন ধান খরিদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করার আবশ্যকতা রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা বা অতিবৃষ্টির কারণে ধান শুকানো ও বাজারজাত করা, গুনগত মান রক্ষা করা বা সঠিক মাত্রায় ধান শুকানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় ভিজা ধান অঙ্কুরিত হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতি হয় এবং ধানের রঙ নষ্ট হওযার কারণে নাম মাত্র মূল্যে ধান বিক্রি করতে হয়। তাদের অভিযোগ সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের প্রায় কয়েক লাখ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুর্দশা দেখার মতো কেউ নেই। সীমাহীন বৈষম্য আর উন্নয়নবঞ্চিত এসব মানুষ ডুবে আছে অন্ধকারে।
হাওরের লাখ লাখ কৃষকের ভাগ্য বদলায়নি আজো। তাদের কান্না শোনার মতো কেউ নেই। ফলে তাদের দুর্ভোগ অবসানে কোনো পদক্ষেপ নেই। লোক দেখানো যেসব কাজ চলে, তা দলীয় লোকদেরই পকেট ভারী করে মাত্র। এবারের কৃষকের ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পেছনে দলবাজি সক্রিয় বলে গণমাধ্যমে প্রায়ই খবর আসে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের বা সুশীলদের কোন ধরনের দৃষ্টিগ্রাহ্য তৎপরতা লক্ষণীয় নয়।
মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য যে বাঁধ নির্মাণ করে সেই বাঁধই দেশের হাওর অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের জন্য কান্না ও দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়ে উঠেছে। একটু বৃষ্টিতেই ভাঙছে বাঁধ, প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। সেইসঙ্গে ক্ষেতের ফসল ও মাছের ঘের ভেসে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হচ্ছেন এসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ। এর ফলে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। এতে করে ওইসব হাওরের বোরো ফসল নিয়ে শঙ্কায় পড়ে কৃষকরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি অর্থবছরে প্রায় কোটি-কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে ফসল রক্ষার্থে বাঁধ নির্মাণে, কিন্তু এসব টাকার কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না, বেশিরভাগ টাকা চলে যায় স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের পকেটে যা টেকসই বাঁধ নির্মাণ করার প্রধান অন্তরায়। এসব বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে সমাজের সকল শ্রেণির অংশগ্রহণ এবং সচেতন হওয়া জরুরি। সেইসঙ্গে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তদারকি কমিটি বা সংস্থা গড়ে তুলতে হবে যাতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রæত তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনা যায়।
বর্ষাকালে হাওরাঞ্চলে প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে ঘর বাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে জানমালের প্রচুর ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে হলে গ্রাম প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা একান্ত অপরিহার্য কিন্তু অত্র এলাকার মানুষ দরিদ্র বিধায় প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে পারে না। ফলে প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়। এনজিওদের মাধ্যমে গোটা কয়েকটা গ্রামে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে বটে কিন্তু সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সকল গ্রামে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ হলে হাওর এলাকার মানুষের চিরকালিন দুঃখ লাঘব হতো।
হাওরে একটা কথার প্রচলন আছে – ‘শুকনায় পাও ও বর্ষায় নাও, এক ফসলে খাও’
‘এই কথায় অভিহিত হাওরাঞ্চলের মানুষের আর্থিক সমস্যা কাটাতে দ্রæত বড় ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ শিক্ষা ও আর্থিক উন্নয়নবিষয়ক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামা দরকার। না হলে একসময়ের সমৃদ্ধ হাওর এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। সেখানকার মানুষ এখন আর ধানচাষে আগ্রহী হতে পারছে না। আসল কথা হলো হাওরাঞ্চলে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত যেসব মূল্যবান সম্পদ রয়েছে, এগুলো কাজে লাগিয়ে একটি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা সম্ভব পর্যটন কেন্দ্র। এই সবকিছুর জন্য দরকার যথাযথ উদ্যোগ। অবশ্য উদ্যোগ যে মাঝে মাঝে নেয়া হচ্ছে না, এমন নয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সময়। তবে তাতে কোনো সমন্বয় নেই। ফলে এতে স্থায়ী কোনো সুফল আসছে না। এ প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে গঠিত হাওর উন্নয়ন বোর্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। এই বোর্ড হাওর উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বছর কয়েক আগে ‘হাওর উৎসব’ বলেও একটা কথা শোনা গিয়েছিলো। কিন্তু তারও দৃশ্যমান কোনো ফলাফল নেই। এই ধরনের লোক দেখানো প্রচারণার পরিবর্তে হাওর উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হোক। জীবিকার সন্ধানে সেখানকার মানুষ এখন দলে দলে রাজধানী ও অন্যান্য বড় শহরে চলে আসছে। কিন্তু মিলছে না তাদের প্রত্যাশিত উপার্জনের উপায়। হাওর এলাকায় মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্য ক্রমেই জাতীয় বোঝা হয়ে উঠছে। তাই দ্রæত এ অবস্থার অবসানের বিষয়টি জাতীয়ভাবে বিবেচনায় নিতে হবে এবং তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধভাবে কৃষকের পাশে ধারাতে হবে। সকলকে সচেতন হতে হবে কৃষকদের ন্যায্য অধিকার এবং উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। কারণ, কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ।

সারোয়ার আহমেদ
লোকপ্রশাসন বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট