এতো শিশুর লাশ একসঙ্গে দেখেন নি এলাকাবাসী

বিশেষ প্রতিনিধি :
সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা. জামালগঞ্জ ও নেত্রকোণার খালিয়াজুরি’র কিছু অংশজুড়ে কালিয়াকোটা হাওর। বিশাল এই হাওরপাড়ের গ্রামগুলোতে বুধবার ছিল শোকের মাতম। এই হাওরপাড়ের মানুষ ট্রলারডুবিতে একসঙ্গে এতো শিশু’র মৃত্যু কখনো দেখেন নি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাওরের আয়নল-কাকাধরা বিলের মাঝখানে ট্রলারডুবে ১০ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এরমধ্যে ৭ জনই শিশু। এঁরা সকলেই হাওরের মাছিমপুর থেকে পেরুয়া গ্রামে স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী ও গ্রামবাসী জানান, মাছিমপুর গ্রামের হাবুল মিয়ার মেয়ের দিকের নাতির বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল মঙ্গলবার। এই অনুষ্ঠানে যাবার জন্য সোমবার বিকালেই মাছিমপুর থেকে হাবুল মিয়ার ৩১ স্বজন পেরুয়া যাবার উদ্দেশ্যে ট্রলারে রওয়ানা দেন। হাওরের আয়নল ও কাকাধরা বিলের মধ্যস্থানে এসে প্রচ- ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। ঝড়, বৃষ্টি ও উত্থাল ঢেউয়ে ডুবে যাওয়াদের মধ্যে বড় ২১ জন সাঁতার কেটে পাড়ে ওঠলেও
৭ শিশু, এক বৃদ্ধাসহ ১০ জন ডুবে মারা যান।
ঘটনার পর রাতেই ৪ শিশুর লাশ উদ্ধার করেন হাওরপাড়ের লোকজন। ভোরে পুলিশ এবং আশপাশ গ্রামের লোকজন অন্তত ৫০ টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযানে নামেন। সকাল ৭ টার মধ্যেই আরও ২ শিশুসহ ৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়। এরপর বেলা বাড়া’র সঙ্গে সঙ্গে সিলেট ফায়ার সার্ভিসের একটি ডুবুরি দল, পুলিশ এবং স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আরও ২ জনের লাশ উদ্ধার হয়।
উদ্ধারকৃতরা হলো- নোয়ারচরের আবজল মিয়ার স্ত্রী আজিরুনন্নেছা (৩০) ছেলে সোহান মিয়া ( ১ বছর ৬ মাস) ও আসাদ (৫), মাছিমপুরের বাবুল মিয়ার ছেলে শামীম (২), একই গ্রামের বদরুল মিয়ার ছেলে আবির মিয়া (৩), পেরুয়া গ্রামের ফিরিজ আলী’র ছেলে শহীদুল (৪), মাছিমপুরের আরজ আলী’র স্ত্রী রহিতুনন্নেছা (৩৪) ও মেয়ে তাছলিমা (১১), জাসদ আলী’র মেয়ে শান্তা (৩) এবং পেরুয়া’র নছিবুল্লার ছেলে করিমা (৭০)।
গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মশকুর মিয়া এবং সালমা বেগম জানালেন, মঙ্গলবার রাতে যখন ৪ ফুটফুটে শিশু’র লাশ গ্রামের জাহেদ মিয়ার বাড়িতে এনে রাখা হয় তখন কেবল শিশুদের স্বজনরা নয় গ্রামের শত শত মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই কেঁদেছেন। পুরো গ্রামে শোকের মাতম দেখা দেয়। রাতে অনেকের বাড়িতে রান্না-বান্নাও হয় নি। এই সংবাদ আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্য গ্রাম থেকেও ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে ভোর রাতেই মাছিমপুরে আসেন অসংখ্য মানুষ।
স্থানীয় রফিনগর ইউপি সদস্য (চার নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য) কুটি মিয়া জানালেন, মাছিমপুর গ্রামের নারী-পুরুষদের অনেকেই রাতে ঘুমান নি। প্রচ- বৃষ্টি এবং ঢেউ থাকায় হাওরে যেতে না পারলেও হাওরপাড়ে এবং মৃত ৪ শিশুর পাশে বসেই রাত কাটিয়েছেন মানুষ।
পাশের ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কুলবাসী চন্দ্র সরকার ও উজ্জ্বল মিয়া জানালেন, শোকাহতদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে এবং উদ্ধার কাজে অংশ নিতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসে যুক্ত হন শত শত মানুষ। বিশেষ করে রফিনগর, মির্জাপুর, মাছিমপুর, চরনারচর, মেঘনা, বারোঘর ও বাসাখরচ গ্রামের মানুষ ট্রলার নিয়ে নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেন।
দিরাই থানার ওসি কেএম নজরুল ইসলাম দুপুরে অভিযানের শেষ পর্যায়ে জানান নিখোঁজ তাছলিমার লাশও উদ্ধার হয়েছে। এরপর কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেন উদ্ধারকারী এলাকাবাসী।
পুলিশ স্বজনদের কাছে লাশ বুঝিয়ে দিলে দুপুর ২ টায় জানাজা শেষে মাছিমপুরের নিহতদের গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়। অন্যদের নিজ নিজ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়।