দিরাই-শাল্লায় চড়া সুদের ঋণের জালে বন্দি কয়েক হাজার কৃষক পরিবার

 

নিজস্ব প্রতিবেদক,দিশাডটকম :-হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লায় আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষিতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেও বর্গাচাষীদের  দুঃসময় কাটছেনা।  সরকারের বর্গা আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় যুগ যুগ ধরে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত  থাকছে বর্গাকৃষক।  ফলে অনায়াসেই জমির মালিক উৎপাদিত  ফসলে অর্ধেক ভাগ বসাচ্ছে। কিন্তু আবাদ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ধান কাটামাড়াই পর্যন্ত সবকিছুর ব্যয়ভার বর্গাদারকেই বহন করতে হচ্ছে। আইন অনুযায়ী বর্গাকৃষক ও জমির মালিকের মধ্যে পাচঁ বছর মেয়াদী লিখিত চুক্তির নিয়ম থাকলেও বাস্তবে হাওর এলাকায় এক বছর মেয়াদী মৌখিক চুক্তিই প্রচলিত রয়েছে । লিখিত চুক্তিনামা না থাকায় ব্যাংক  কৃষি ঋণ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বর্গা চাষীরা। এভাবে বছরের পর বছর ধরে বাধ্য হয়ে গ্রাম্য মহাজনের চড়া সুদের ঋনের বেড়াজালে আটকে আছেন হাওর পারের বর্গা কৃষকরা। জমির মালিক ও বর্গা কৃষকের মধ্যে সুষমবন্টনের জন্য বর্গা আইন যুগোপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন এলাকার জনপ্রতিনিধিগণ। আর এবছর নতুন করে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন গ্রাম্য বড় বড় মহাজনী কৃষকরাও। গত বছর প্রতি কেদার জমি ৩/৪ হাজার টাকা করে রমজমা( একসনা লীজ) দিয়েছেন কিন্তু এবছর ধানের দাম কম থাকায় বর্গাচাষীরা জমি লীজ নিতেই চায় না। বড় কৃষকদের বহু জমি এবছর পতিত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

পরিসংখ্যান অফিসের হিসাব মতে, দিরাই-শাল্লার দুই উপজেলায় হাওরপারে গ্রাম রয়েছে চার শতাধিক। এসব গ্রামে বসবাস করছেন অর্ধলক্ষাধিক কৃষক পরিবার । এর মধ্যে বর্গা কৃষক পরিবারের সংখ্যা অন্তত ২০ হাজার। উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা গেছে, জমি চাষাবাদ থেকে শুরু করে বীজ, সার ,সেচ,কীটনাশক ও শ্রমিকসহ সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হয় বর্গা কৃষককেই । অথচ উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক দিয়ে দিতে হয় জমির মালিক কে । যে কারণে জমির মালিকসহ উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে বর্গাদারের ভাগে তেমন কিছুই থাকেনা । এতে অনেকেই কৃষি বিমূখ হয়ে পড়েছেন। কৃষকরা বলেছেন , আগে যেখানে তারা হালের বলদ আর লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করতেন , এখন সেখানে ব্যবহার করতে হচ্ছে ট্রাক্টর । সেচের জন্য বৃষ্টির পানি বদলে সেচ যন্ত্র আর ধান মাড়াইয়ের জন্য মাড়াই কল । এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যে খরচ হয় তার সবটাই কড়া সুদে আনতে হচ্ছে গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে।দিরাই-শাল্লার চাপতি, বরাম ও কালিয়াকোটা হাওর পারের বাসিন্দা  বর্গাচাষী আলাউদ্দিন (৫৫), এলাইছ মিয়া(৫০),শামসুদ্দিন(৪৫), জালালদ্দিন(৪২), নাছির উদ্দিন(৪০) মহাদেব  দাস(৪৫)। এদের কারো নিজের এক ছটাক জমি নেই হাওরে ।  প্রতি বছর অন্যের জমি বর্গা চাষ করতে গিয়ে আটকে পড়েছেন চড়া সুদের ঋণজালে । তাদের ভাগ্যে জুটে না ব্যাংকের কৃষি ঋণ । দিরাই ও শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েক গ্রামের  বর্গা কৃষকের জীবন-জীবিকার চালচিত্র তুলে ধরে  আরেক বর্গা কৃষক  জানালেন, জমি চাষ করে ফসল উঠানোর পর বর্গাদারের হিস্যা আর গ্রাম্য মহাজনের চড়া সুদের পাওনা মিটিয়ে ২-৩ মাস পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোভাবে চলা যায় ।কিন্তু এ বছর বোরো ধানের দরপতনের কারনে উৎপাদিত ফসল ফলাতে যে খরচ হয়েছে তা বিক্রিত  দামের প্রায় দ্বিগুণ। জমি চাষ করে বর্গাদারের হিস্যা আর গ্রাম্য মহাজনের চড়া সুদের পাওনা পরিশোধ করতে গিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে তারা।অনেকেই পরিবারের ভরন পোষন জোগাড় করতে না পেরে কাজের সন্ধ্যানে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।  বর্ষায় কেউ ধানের নৌকা , কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা , আবার কেউ হাওরে মাছ ধরে কোনরকমে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অগ্রহায়ন পৌষ মাসে আয় -রোজগারের কোনো পথই থাকে না তাদের। ওই সময়ে নতুন করে জমি চাষাবাদের জন্য অগ্নিমূল্যে সার- বীজ ও চাল-ডাল কিনতে গিয়ে পুনরায় ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন তারা । কালিয়াকাটা হাওরপাড়ের মাছিমপুর গ্রামের কয়েকজন বর্গাকৃষক জানান, বর্তমান বাজারে ধানের যে মূল্য রয়েছে তাতে করে এক মণ ধান বিক্রি করে ১ কেজি বীজ কিনতে হবে। এমন চিন্তা করে হাওর এলাকার বহু বর্গাচাষী বোরো জমির চাষাবাদ করা ছেড়ে দিয়েছে। আর এনিয়ে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন গ্রামের বড় বড় মহাজনী কৃষকরাও। মাছিমপুর গ্রামের কৃষক জাহেদ মিয়া বলেন গত বছর প্রতি কেদার জমি ৩/৪ হাজার টাকা করে রমজমা( একসনা লীজ) দিয়েছেন কিন্তু এবছর ধানের দাম কম থাকায় বর্গাচাষীরা জমি লীজ নিতেই চায় না।  নিজেরা গিয়ে তাদেরকে জমি দিতে চাইলেও দেড়-দুই হাজার টাকার বেশি দিতে চায় না।একই কথা বললেন শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের মহাজনী কৃষক জনি মনির। তিনি বলেন বর্গাচাষীরা যেভাবে কৃষি জমি চাষাবাদ বিমূখ হচ্ছে, আমাদের মতো বড় কৃষকদের বহু জমি এবছর পতিত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

বরাম হাওরপারের ভাঙ্গাডহর গ্রামের কৃষক প্রফুল্য, কৃতিষ ও জ্যোতির্ময় দাস জানান, একযুগ আগেও বর্গা চাষের ক্ষেত্রে আধাভাগি ও তিন ভাগি নিয়ম ছিল । আধাভাগির ক্ষেত্রে জমির মালিক জমি চাষ করে দিতেন এবং তিন ভাগির বেলায় বর্গাদার নিজেই সব খরচ বহন করতেন। সেই সময় স্থানীয় জাতের ধান চাষ হত। সার ও কীটনাশকের কোনো প্রয়োজন ছিল না। চাষাবাদ খরচও তেমন ছিলনা। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে চাষাবাদ পদ্ধতি বদলে গেছে ,বেড়েছে জমি চাষ খরচ ও বীজ সারের দাম। কিন্তু বর্গা আইনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এতে বর্গা কৃষকরা সুষম বন্টন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ।  তাই সময়ের প্রয়োজনে বর্গা আইনকে যুগোপযোগী করার দাবী উঠেছে।