বুলবুলের প্রভাবে বৃষ্টি: আশ্রয়কেন্দ্রে ১৭ লাখ মানুষ

দিশা ডেস্ক :: ঘূর্ণিঝড় বুলবুল গতকাল সন্ধ্যায় উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে গতকাল বিকালে আবহাওয়াবিদরা জানান, মধ্যরাত নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে। তবে তার আগেই উপকূলে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হয়। এ ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষায় এরই মধ্যে উপকূলবর্তী ১৪টি জেলার ১৭ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

‘বুলবুল’ আঘাত হানার আগে গতকাল বাগেরহাটের উপকূলীয় শরণখোলা, মোংলা ও মোড়েলগঞ্জের বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয়প্রার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। সন্ধ্যা থেকেই জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ভিড় বাড়তে থাকে। রাত যতই ঘনিয়ে আসে, আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। কোনো কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সর্বশেষ রাত ৮টা পর্যন্ত বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মূল্যবান জিনিসপত্র আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, জেলার ৩৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে রাত ৮টা পর্যন্ত ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য শুকনো খাবার ও পানি সরবরাহ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে। রাতেও কন্ট্রোল রুম চালু থাকবে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে কক্সবাজারে গতকাল সারা দিনই বৃষ্টি ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি পূর্ণিমা তিথির জোয়ারে স্বাভাবিকের চেয়ে সাগরের পানি বেড়েছে সাত-আট ফুট। এতে উপকূলের নিচু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কুতুবদিয়া, মহেশখালীর ঘলঘাটা, মাতারবাড়ী এলাকায় জোয়ারের পানিতে লোকালয় প্লাবিত হয়।

এদিকে বুলবুলের তীব্রতা শুরু হলে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ভূমিধস ও ঝুপড়ি ঘরগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাহাড়ধসের শঙ্কা রয়েছে জেলা শহরসহ পাহাড়ি অন্যান্য এলাকায়ও। তাই বুলবুলের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি রোধে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় এসব কথা জানান জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, জেলার আট উপজেলায় ৫৩৮টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খোলা রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বহুতল ভবনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও। উপকূল হিসেবে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সদরের পোকখালী, চৌফলদণ্ডী, খুরুশকুল, টেকনাফের সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্ট মার্টিনে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে জেলার উপকূল এবং আশপাশ এলাকার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা এবং ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সহযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেয়া রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে গতকাল সকাল থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি দমকা হাওয়া বইতে থাকে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন কয়রার বাসিন্দারা।

হরিণখোলা এলাকার লোকজন আশঙ্কা করছেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানলে গ্রামের সামনের ছোট্ট বেড়িবাঁধটি ভেঙে লোনাপানিতে পুরো এলাকা ভেসে যাবে। এ এলাকার লোকজন দড়ি দিয়ে ঘর শক্ত করে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেন। অনেকে গরু-ছাগল নিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যান।

খুলনার কয়রা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিমুল কুমার সাহা বলেন, বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। ১২টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। কয়রা উপজেলাজুড়ে ১২১টি সাইক্লোন শেল্টারসহ বিভিন্ন বিদ্যালয় ভবন, পাকা ও নিরাপদ স্থাপনায় মানুষজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও থানা পুলিশদের নিয়ে আলাদা টিম গঠন করা হয়েছে। নিরাপদ পানি ও খাদ্য মজুদ করা হয়েছে।

ভোলায় ১০ নম্বর মহাবিপত্সংকেত ঘোষণার পর থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় খোলা হয়েছে আটটি কন্ট্রোল রুম। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬৬৮টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ কয়েকশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সব বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ৯২টি মেডিকেল টিম। জেলার সব অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে গতকাল দুপুর থেকে বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। বইছে হালকা থেকে মাঝারি ঝড়ো হাওয়া।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ছয়-সাত ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে—এমন আতঙ্কে রয়েছে উপকূলের দুই লক্ষাধিক মানুষ। বহু জায়গায় বেড়িবাঁধ না থাকায় এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে সেখানকার মানুষ।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সাতক্ষীরায় দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিসহ ঝড়ো হাওয়া বইছে। আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে ১০ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশ, বিজিবি, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে গঠিত টিম উপকূলবর্তী মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে আনার কাজ শুরু করেছে। হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিক সার্বক্ষণিক খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক এস এস মোস্তফা কামাল জেলার ২৭০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ২ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া দুর্যোগকবলিতদের সহায়তায় ৩১০ টন চাল, নগদ ৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ২৭ হাজার পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পর্যাপ্ত ওষুধ মজুদ রাখা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কবলে পড়ে বরগুনার বিভিন্ন এলাকার সাতটি মাছ ধরার ট্রলারসহ ৬৪ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছে। এর মধ্যে তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইউনিয়নের একটি ও নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের পাঁচটি ট্রলার নিখোঁজ হয়েছে ৪৮ জন জেলেসহ। আর বরগুনা সদর উপজেলার নলী গ্রামের একটি ট্রলার ১৬ জন জেলেসহ নিখোঁজ রয়েছে।

এদিকে বুলবুলের প্রভাবে বরগুনার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, বরগুনার ৫০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে এবং ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন থেকে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে শুক্রবারের মতো গতকালও দিনভর বরিশাল বিভাগজুড়েই বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করে। গতকাল সকাল থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদ-নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। আর আবহাওয়া অফিস থেকে বরিশাল নদীবন্দরে ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিদর্শক কবির হোসেন। তিনি বলেন, এর আগে শুক্রবার থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। আর কেন্দ্রীয়ভাবে উপকূলমুখী নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তায় বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরায় পাঁচটি, চট্টগ্রামে তিনটি ও সেন্ট মার্টিনে দুটি যুদ্ধজাহাজসহ নৌ কন্টিনজেন্ট ও মেডিকেল টিম মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। খুলনা অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণ তত্পরতা পরিচালনায় বানৌজা কর্ণফুলী, তিস্তা, পদ্মা, এলসিভিপি ০১২ ও এলসিভিপি ০১৩ মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি চারটি নৌ কন্টিনজেন্ট যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে তিনটি জাহাজ বানৌজা শাহজালাল, শাহ পরান ও অতন্দ্র দ্রুততম সময়ে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকায় ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে বানৌজা সমুদ্র জয় ও সমুদ্র অভিযান জরুরি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সেন্ট মার্টিনে অবস্থান করছে। তাছাড়া নৌবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সেন্ট মার্টিনে আটকে পড়া পর্যটকদের নিরাপদ আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।

খুলনা নৌ অঞ্চল থেকে মোতায়েনকৃত জাহাজগুলো বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ২০০০ প্যাকেট জরুরি খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করবে। যার প্রতিটি প্যাকেটে রয়েছে সাড়ে সাত কেজি চাল, দেড় কেজি ডাল, দেড় লিটার সয়াবিন তেল, এক কেজি চিড়া, এক কেজি মুড়ি, আধা কেজি গুড়, আধা কেজি বিস্কুট, দুই লিটার বিশুদ্ধ পানি, দুই ডজন মোমবাতি, দুই ডজন দিয়াশলাই বাক্স এবং জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় স্যালাইন ও ওষুধ। এছাড়া দুর্গত এলাকাগুলোতে জরুরি চিকিৎসা সহায়তার জন্য পাঁচটি বিশেষ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও খাবার স্যালাইন বিতরণের কাজে নিয়োজিত থাকবে। পাশাপাশি চারটি নৌ কন্টিনজেন্ট যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে।

ইতিমধ্যে সেন্ট মার্টিনে নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ সমুদ্র জয় ও সমুদ্র অভিযান দুই টন চিড়া, এক টন মুড়ি, দুই টন চাল, দেড় টন গুড়, ৫০০ কেজি ডাল, ৭০০ কেজি চিনি, ৫০০ প্যাকেট মোমবাতি, ২৫০ ডজন দিয়াশলাই নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি সেন্ট মার্টিনের ফরওয়ার্ড বেইসের নৌসদস্যরা জরুরি উদ্ধার ও ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম ও ঢাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুদ্ধজাহাজ ও নৌ কন্টিনজেন্ট অনুরূপ ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে।

সূত্র- বণিকবার্তা