করোনা’ ও আমাদের করণীয়। *এম আবুল হোসেন শরীফ*

 

বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর আগ্রাসী ছোবলে মৃত্যুর মিছিলে পাঁচ লাখেরও বেশি প্রাণ কয়েক মাসের ব্যবধানে হারিয়ে গেলেন। পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত। বিশ্ববাসী হতবাক।উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কগ্রস্থ মানব জাতি আজ দিশেহারা। আতংকিত হওয়ার চেয়ে মনোবল বাড়ানো অধিক শ্রেয়। শ্রেষ্ঠ মানব জাতি গণ্ডি পেরিয়ে যখন সীমালংঘনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখনই সৃষ্টি কর্তা তার সৃষ্টিকে বুঝিয়ে দিতে চান সীমানা লঙ্ঘন ভয়ঙ্কর প্রকৃতি বিরোধী। তাই তার ফলও কন্টকাকীর্ণ।
সময়-কালে বৈশ্বিক এই মহামারী থেকে উত্তরণে বিশ্ববাসী উন্মুখ হয়ে আছে। অভিশপ্ত অমাবস্যার আঁধার পেরিয়ে সকলেই একটি ভোরের আলোর অপেক্ষায়।
বুর্জোয়াএবং সাম্রাজ্যবাদী শাসনে পৃথিবীর মানব জাতি যখন নিষ্পেষিত। মানবতা যেখানে ভূলুণ্ঠিত। বর্ণবাদের নতুন ধারা যখন বিশ্বায়নের যুগে বিভাজনে তৎপর। নীরবে-নিভৃতে নির্যাতিত সৃষ্টির সেরা মানব কুলের আর্তনাদ। পুঁজিবাদের অট্টালিকা অপরদিকে বস্তুহারা নিঃস্ব মানুষ।
আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা জাতি। ভুলে গেছি দায়িত্ব ও কর্তব্য। যুগে যুগে মানব জাতি যখন তার কর্তব্য এবং দায়িত্ব থেকে পদস্খলন ঘটে তখনই স্রষ্টা তার সৃষ্টি কে স্মরণ করিয়ে দিতে চান মানুষ কেন সৃষ্টির সেরা। সবকিছুর মালিক মহান আল্লাহ তাআ’লা। এখানে সবখানে তারই রাজত্ব বিরাজমান।

প্রাণঘাতী করোনা’ সৃষ্ট পরিস্থিতি আমাদের জীবন ও পরিবেশে দীর্ঘসময় বিরাজ করবে তাতে সন্দেহ নেই। সহসাই পরিত্রান পাচ্ছেনা বিশ্ববাসী।
করোনা’ কালীন সঙ্কটের মধ্যেও জীবনের প্রয়োজনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সহ জীবন চালিয়ে যেতে হবে। আতঙ্কিত ও ভীত না হয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে নতুনভাবে অভ্যস্ত হতে হবে।
বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ, প্রিয় বাংলাদেশ। আয়তনের দিক দিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী হোম কোয়ারেন্টাইন অথবা লকডাউন দীর্ঘ সময় মেয়ে নেওয়া স্বাভাবিক জীবনে অতি কষ্টকর ও হতাশাব্যঞ্জক। তবুও বাস্তবতার নিরিখে আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে সরকারি বিধি নিষেধ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে। যারা কর্মজীবী। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে, সর্বত্র মাস্ক পরা অত্যাবশ্যক। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। বারবার স্যানিটাইজার/সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস এবং একে অপরের সাথে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে এ পর্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি।

জীবাণু ছড়ায় হাঁচি-কাশির সাথে নির্গত অনুকণা বা ড্রপ লেটের মাধ্যমে। হাঁচি-কাশির সময় রুমাল বা টিস্যু দিয়ে অথবা কনুইয়ের ভাজে মুখ ঢেকে রাখতে হবে। যেখানে সেখানে কফ বা থুথু ফেলা যাবে না। হ্যান্ডশেক বা কোলা-কুলি থেকে বিরত থাকতে হবে।
ধূমপানে অভ্যস্ত ব্যক্তিরা সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। সুতরাং ধূমপান পরিহার করতে হবে।

অফিসে কিংবা কর্মক্ষেত্রে বাথরুম ব্যবহারে সর্তকতা অবলম্বন জরুরি। নিতান্তই গণপরিবহন ব্যবহার করতে হলে প্রয়োজনীয় ব্যক্তি সুরক্ষা ব্যবস্থা, মাস্ক ব্যবহার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সাথে রাখতে হবে। কেউ সংক্রমিত হলে গণপরিবহন ব্যবহার করা উচিত নয়। বিষয়টি সামাজিক ভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্টেশন প্রাঙ্গন এবং যানের অভ্যন্তরে, যাত্রীদের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, যানের মেজে, পৃষ্ঠতল, যানের বডি জীবাণু-নাশক দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা। সব হাত রাখার স্থান, সম্পূর্ণ প্রবেশদ্বার ও হাতল, এবং সর্বক্ষেত্রে চেয়ার-টেবিল, ডেস্ক, টেলিফোন ও কম্পিউটার-কি বোর্ড ইত্যাদি ব্যবহারে সর্তকতা অত্যাবশ্যকীয়।

বাজার-হাটে অযথা ঘোরাফেরা করা যাবে না। প্রয়োজনে সদাই ক্রয়ে বাজারে জনসমাগম এড়িয়ে সচেতনতার সহিত বাজার-সদাই করতে হবে। মনে রাখতে হবে সামান্য ভুলে পরিবার ও সমাজের বড় ক্ষতি হতে পারে।

মহামারীর সংকটময় মুহূর্তে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও বিশ্বের ইসলামিক স্কলারসগণ জামাতে নামাজ পড়ার যে নীতিমালা দিয়েছেন তা, মানা অধিক কল্যাণকর। জুম্মার নামাজ এবং ঈদের জামাতের পরে কোলা-কুলি করা যাবে না।

বিদেশ ফেরত ব্যক্তিগণ নিজের পরিবার, প্রতিবেশী ও দেশের স্বার্থে দুই সপ্তাহের জন্য হোম কোয়ারেন্টাইন বা সঙ্গ নিরোধে থাকতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী/অভিবাসী বাংলাদেশি আছেন। অনেকে আসতে চাইলেও সংকটের কারণে আসা হচ্ছেনা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে অনেকেই লকডাউনে আছেন। দেশ-মাটি ও মানুষকে নিয়ে প্রতিনিয়ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জীবন কাটাচ্ছেন। আত্মবিশ্বাস এবং মনোবল বাড়াতে হবে। সময়-সুযোগে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে ভার্চুয়াল যোগাযোগ করতে পারেন। ইবাদতে সকলের জন্য দোয়া ও বিশ্ববাসীর শান্তি কামনা করা যেতে পারে।

করোনা’র ধ্বংসলীলায় প্রযুক্তি আর আধুনিকতা বিপর্যস্ত। করোনা’র ক্ষমতা প্রচণ্ড শক্তিগুলোকে হার মানিয়েছে। দিশেহারা শক্তির উৎস গুলো। বেঁচে থাকাটা সকলের কাছে আজ যেন পরম চাওয়া। সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধহীন আদর্শ সর্বদিকে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সংঘর্ষ, হানাহানি থেমে নেই।
এটলিস্ট এ সময়ে গুজব, ট্রল, কিংবা পলিটিক্যাল ইস্যুতে ডাইভার্ট না করে, কাউকে ব্লেম না দিয়ে নিজের এবং পরিবারের স্বার্থে একে অন্যকে সাপোর্ট করতে হবে। হয়তো মানুষের হিংসা,ক্ষোভ, অহংকার কে চুরমার করে সকলের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্প্রীতি,সহনশীল হওয়ার এই কঠিন পরীক্ষা। সুতরাং যথাসম্ভব সংঘর্ষ, হানাহানি, মারামারি থেকে বিরত থাকতে হবে।

ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বন্ধু, সহপাঠীদের থেকে বিচ্ছিন্ন দিনগুলো শিশু-কিশোরদের নিঃসঙ্গ বোধ হতে পারে। তাদের এই নিঃসঙ্গতা কাটাতে খেলার ছলে শেখায় মেতে উঠতে পারেন মা-বাবারা। সন্তানদেরকে আপদকালীন সময় পর্যন্ত ঘরে বসে পাঠদান এবং মজার মজার গল্প ও বাড়ির আঙ্গিনায় শারীরিক কসরত এর মাধ্যমে খেলাধুলায় সময় কাটানো যেতে পারে। শরীরচর্চা ও মেডিটেশনের মাধ্যমে সময়কে কাজে লাগানো যেতে পারে।

করোনা’বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে আজ মানুষ যেন মানবিক দায়িত্ববোধ হারাতে বসেছে। অসুস্থ মানুষের সেবা পাওয়া মৌলিক অধিকারে পরে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝির পরিপ্রেক্ষিতে করোনা’ আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের বিষয়ে ধর্মীয় দায়িত্ব চরমভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে করোনা’রোগীর পাশে দাঁড়ানো, তাকে সাহস যোগানো এবং সে মারা গেলে তার দাফন কাফন জানাযার ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইহা আমাদের ধর্মীয় এবং নৈতিক দায়িত্ব।

বৈশ্বিক সমস্যা আজকে সকলকে তাড়িত করছে।তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষজন চরম বিপাকে। দুমড়ে মুচড়ে একাকার নিঃসম্বল পরিবারগুলো। মানবতার ক্লান্তিলগ্নে, সরকারী ত্রানের পাশাপাশি সুহৃদ, উদার, দানশীল ব্যক্তিত্ব এবং প্রতিষ্ঠান অসহায় পরিবার ও মানুষকে মানবিক সহযোগিতার হাত নিজ অবস্থান থেকে প্রসারিত করতে হবে।
মানুষ, মানুষের জন্য ।
জীবন, জীবনের জন্য।
মনে রাখতে হবে এটা কোন করুণা নয়। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া কর্তব্য।
কর্মসংস্থান সংকোচিত না করে বাড়াতে হবে। একে অন্যের দুঃখে ও সুখে সহমর্মিতা, ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করতে হবে।

প্রকৃতির প্রতিশোধের মুখোমুখি আমরা।
কোভিড-১৯ আমাদের আবারো স্মরন করিয়ে দিচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দ্বারা আমরা সুন্দর পৃথিবীটাকে দিনে দিনে বিষাক্ত করে তুলেছি। আজ তাই আমাদের সব ধরনের কর্মকান্ডের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব নতুন করে ভাবতে হবে। পরিবেশ বান্ধব সমাজ অতীব জরুরী।

ব্লিচিং পাউডার দিয়ে সহজেই ঘরে জীবানুনাশক তৈরি করা যেতে পারে। যেহেতু আয়- রোজগারের পথ সংকোচিত হচ্ছে। সেহেতু সাংসারিক খরছাদিতে অপচয় কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ভিটামিন সি যুক্ত খাবার ও ফলমূল বেশি বেশি খাওয়া যেতে পারে। নিয়মিত কুসুম গরম পানি, আদা চা এবং গরম স্যুপ পান করার অভ্যাস করতে পারলে ভালো হয়। লবণ মিশ্রিত কুসুম গরম পানি দিয়ে দিনে তিন/ চারবার গড়গড়া করা এবং নাকে মুখে গরম পানির ভাপ উপকারী বটে। জ্বর,সর্দি- কাশি, গলা ব্যথা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
করোনা’ কালীন সময়ে সর্বক্ষেত্রে আমাদের জীবনযাপনে কর্মকৌশল এবং জীবনের প্রয়োজনীয় সব কাজে সর্তকতা অবলম্বন করা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অপরিহার্য কর্তব্য।

ঘরের মেঝে, আসবাবপত্র। জীবাণুনাশক ব্যবহার করা এবং ঘর, বাড়ি, ও আঙ্গিনা সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সর্বোপরি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই অবস্থান করতে হবে। মনে রাখতে হবে বাইরে থেকে ঘরে আসলে পরিধানের কাপড়, সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে ।
সম্ভব হলে গোসল করতে হবে।

পরিবারে সবার সাথে থাকা উপভোগ করতে হবে। কারণ আপনি হয়তো ব্যক্তিগত অথবা কর্মজীবনে যতটুকু প্রাকটিক্যাল পরিবারের অনেকে হয়তো বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ হতে যাওয়া মৃত্যুর মিছিল কে মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা নেই।
দুশ্চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে।

বেশি বেশি ইবাদতে মশগুল হলে মনে প্রশান্তি আসবে। কোরআন তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করা যেতে পারে।
মহান আল্লাহর কাছে, মাগফিরাত, হেফাজত চাওয়া, সেজদায় ক্রন্দন করা জরুরি।
প্রত্যেকেই নিজ ধর্ম মতে স্রষ্টার প্রতি অনুতপ্ত হওয়া ও ক্ষমা চাওয়া একান্ত কাম্য।

অসাবধানতায় যে কেউ যেকোনো সময়,যেকোনো বয়সের নারী- পুরুষ করোনা’য় আক্রান্ত হতে পারেন। নিজে সচেতন হবো।
অন্যকে সচেতন করব।
সব সময় সতর্ক থাকবো।
মনে রাখতে হবে এটা আমার দেশ প্রেম।