ডুবছে হাওর, কাঁদছে চাষীরা

ইমরান হোসাইন:

সুনামগঞ্জের হাওরে কৃষকের ফলানো বোরো ধান এখনো সবুজ, কাঁচা। পাকতে আরো সপ্তাহ দুয়েক সময় নেবে। এরমধ্যেই উজানের পাহাড়ি ঢলে কৃষকের শ্রমে–ঘামে ফলানো এসব ‘সোনার ফসল’ চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে।গত রোববার তাহিরপুরের নজরখালি বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরের পানি প্রবেশ করে পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। সোমবার জেলার দিরাই ও শাল্লা উপজেলার দুটি হাওরের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির ধান বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। সারা বছরের খাদ্যসহ পরিবারের ভরণ-পোষনের একমাত্র অবলম্বন উঠতি সোনার ফসল চোখের সামনে তলিয়ে যাওয়া দেখে গ্রামে গ্রামে চলছে হাহাকার।পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানা যায়, হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১২টি হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বেড়িবাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে পাঁচ সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও বাঁধের মেরামত বা সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয় কৃষকদের। ফলে বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢল আর অকাল বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক হাওরের কোটি কোটি টাকার বোরো ধান। এ নিয়ে শঙ্কা আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন জেলার কৃষকেরা।

অভিযোগ রয়েছে সরকারি দলের স্থানীয় কতিপয় নেতাদের যোগসাজসে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) করা হয়। ফলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দায়সারা ভাবে হাওররক্ষা বাঁধ মেরামতের কাজ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর হাওর পাড়ের কৃষকদের স্বার্থ উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্তারা মেতে থাকেন মৌসুমী বাণিজ্যে। ইতোমধ্যে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কযেকটি বাঁধ ধসে গেছে। শতভাগ কাজ শেষ না হতেই বৃষ্টিতে বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। দিরাই উপজেলার সর্ববৃহত বরাম হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তুফানখালী বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল।রোববার এ বাঁধ পরিদর্শন করেন দিরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরী, পাউবো সিলেট জোনের প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম, তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গুস্বামী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কুলঞ্জ ইউনিয়নের টাঙ্গুয়ার হাওর ২৮নং প্রকল্পে একটি বড় ধস দেখা দিয়েছে। সাকিতপুরের ঢালার খালের বাঁধের নিচে ছিদ্র হয়ে হাওরে পানি প্রবেশ করায় স্থানীয় কৃষকেরা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতে নেমেছেন। সরকারি দলের সিন্ডিকেট কমিটি আর পাউবোর দুর্বল মনিটরিং, বাঁধের কাজে ধীরগতি ,সঠিক সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার ফলে সব বাঁধ ঝুকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় কৃষকেরা।এদিকে শাল্লা উপজেলার বাঘার হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে। কৃষকদের চোখের সামনেই ভেঁসে যাচ্ছে হাজার একর ফসলি জমি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতার বাহিরে হওয়ায় এই বাঁধটিতে দেয়া হয়নি কোনো প্রকল্প। শুরু থেকেই বাঘার হাওরে প্রকল্প দেয়ার দাবি জানালেও পাউবো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। গতকাল সোমবার বিকেল ৩টায় নদীর পানি উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করেছে। নিমিষেই তলিয়ে গেছে কৃষকদের ফসল। নিজেদের ফসল তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও কাঁচি হাতে নেমেছে ধান কাটতে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়,শাল্লা উপজেলার বাঘার বাঁধ এলাকায় প্রায় এক হাজার একর জমি রয়েছে। শুরু থেকেই এই এলাকায় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রকল্প না দিয়ে অপ্রয়োজনীয় জায়গায় প্রকল্প দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট করছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) দাবি করছে সার্ভে টিমের ম্যাজারমেন্ট অনুযায়ী প্রকল্প দেয়া হয়েছে। যার ফলেই এই হাওরের বাঘার বাঁধটি আওতার বাহিরে।

দামপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল আউয়াল বলেন, ১০ কেয়ার জমি করেছিলাম,এই হাওরেই সকল জমি। আমার চোখের সামনেই সবকিছু ভেঁসে যাচ্ছে। এখন ছেলে মেয়ে নিয়ে কিভাবে চলবো এই চিন্তাই করছি। কৃষক আবু বক্কর বলেন, ৫০ কেয়ার জমির মাঝে ডুবে যাওয়া হাওরেই আমার ৩০ কেয়ার জমি। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ূন রশিদ লাবলু বলেন,রাজনগর (হালেয়া) ও ভাটিয়ার গাও-গ্রামের সামনের হাওরে কমপক্ষে ৫ শ হেক্টর রোরো জমির ধান তলিয়ে গেছে। গ্রামে চলছে সরব হাহাকার।

শাল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারি প্রকৌশলী(এসও) আব্দুল কাইয়ুম বলেন, হাওর রক্ষা বাঁধ এখনো ভাঙেনি। যেদিকে বাঘার হাওরে পানি প্রবেশ করেছে এটা পাউবোর প্রকল্প তালিকার বাহিরে। আর আমাদের আওতায় যে বাঁধগুলো রয়েছে সেগুলি মনিটরিং করা হচ্ছে। তবে উজানের পানি যে ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে,মনে হয় আস্তে আস্তে সবগুলি ঝুঁকিপূর্ণ হবে।।এ বছর দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১২টি হাওরের ফসল রক্ষায় বেড়িবাঁধের ৩০ টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার রয়েছে বলে জানিয়েছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দুই উপজেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলি এ টি এম মেনায়েম হোসেন ও আব্দুল কাইয়ূম।