ভাষা হারানোর বেদনা

অ্যাড. এনাম আহমদ
কাঁদছে সুনামগঞ্জ সিলেট ঢাকা… কাঁদছে লন্ডন.. মানচেস্টার.. নিউইয়র্ক, যেখানে ভাষার পদচারণা পড়েছে, কিংবা পড়েনি। ভাষার নামাজের জানাজা.. মাইকিং হচ্ছে শহরে! সেটা শুনতে হচ্ছে! ভাষার জানাজার মাইকিং.. ভোর থেকেই শেষ আষাঢ়ের বর্ষণে প্লাবিত শহর, এ যেন ভাষার জন্য আর্তনাদ!
আশির দশকের মধ্যভাগে জন্ম নেয়া ব্যতিক্রমী নামের অধিকারী ভাষা। আচার ব্যবহারও ব্যতিক্রমী। তৎকালীন সুনামগঞ্জ শহরটাও ছিল ব্যতিক্রমী। ছোট্ট শহর। সবাই সবার চেনা-জানা। সুনামগঞ্জ প্রগতিশীল লড়াই সংগ্রামের উর্বর ভূমি। এর মধ্যে তৎকালীন বাস স্টেশনে (বর্তমানে পুরাতন বাস স্টেশন) বাসা বাড়ি খুব বেশি ছিল না। এর মধ্যে কয়েকটি বাসা বাড়ি থাকলেও সেগুলো ছিল মূলত একটি পরিবার। কারো বাসায় ভাল কিছু রান্না হলে তা পরিবেশন করা হতো অন্যান্য বাসাগুলোতেও। পাড়ায় প্রথম টেলিভিশন আসে শাহানা আপাদের বাসায়। আমরা সেখানে নিয়মিত দর্শক। এক বাসায় যেহেতু টিভি আছে তাই পাড়ার অন্য অভিভাবকগণ টিভি কেনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। তখন সবচেয়ে বড় প্রভাত ফেরির মিছিল বের হতো জালাল দার হোটেল জালালাবাদের সামনে থেকে। তখন অনেকে বাসা বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলের বাগান করতেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যারা শ্রদ্ধা জানাবেন, তারা যেনো বাগান থেকে ফুল চুরি করে নিয়ে যেতে পারেন, সে আশায়! উল্লেখ্য, শহরে তখন ফুলের কোনো দোকান ছিলো না।
এরমধ্যে আমাদের ভাষার জন্ম। চারদিকে কত আনন্দ! ভাষার পিতা গোলাম রাব্বানী বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিংবদন্তিতুল্য ছাত্রনেতা, বৃহত্তম ছাত্র গণসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয় নেতা। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপিও ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ভাষার আম্মা শাহানা আপাও পর্যায়ক্রমে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী, কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও সংসদ সদস্য হন। বর্তমানে তিনি সুনামগঞ্জ জজ কোর্টের পিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
‘ভাষা’ শাহানা আপাদের পরিবারের প্রথম সন্তান। সম্ভবত; পাড়ারও। এজন্য সে সবার আদর পেয়েছে অফুরন্ত। শুধু তার মামা শামছুল আবেদীনের কোলেপিঠে সে বড় হয়নি। একই স্নেহ মমতায় সে ধন্য ছিল পাড়ায় জালাল মামা, বাবলু মামা, সালেহ মামা, তৌফিক দোলন মামা ও সেলিম মামাদের।
আমাদের আগের প্রজন্মের মামা- খালাদের আদর ভালোবাসায় সব সময় ভাষা সিক্ত থাকতো। আমি, শিমুলসহ পাড়ার সমবয়সীরা তখন স্কুলে পড়তাম। তখন ভাষাকে কোলে নেয়ার শিডিউলই আমরা পাইনি। পরবর্তীতে স্মরণ ও কথার জন্ম হলে আমাদের কিছুটা দিন ফিরে।
ভাষা সুনামগঞ্জের আর্দশ শিশু শিক্ষা নিকেতনে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে সরকারি এসসি গালর্স স্কুল থেকে ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। সে যেহেতু দুই ভিপির সন্তান, তাই নেতৃত্বগুণ জন্মগত ভাবেই আয়ত্ব করে নিয়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েই সে ছাত্র ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ২০০৩ সালে মারুফ মান্না’র নেতৃত্বে জেলা সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন গঠিত হলে ঐ বছরই পুরাতন কোর্টের বটতলায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ভাষা, আ.স.ম মাসুমসহ অন্যান্যরা। পরবর্তী কয়েক বছরও সুনামগঞ্জের পহেলা বৈশাখের প্রধান আয়োজনটি করতো সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন।
ভাষা আইন বিষয়ে অর্নাস ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে ঢাকার সাউথ- ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১২ সালে আইন পেশার সনদ প্রাপ্ত হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করে আমাদের ভাষা। ২০১৪ সালটা আমাদের জন্য ছিল অত্যন্ত আনন্দের। শাহানা আপা সংসদ সদস্য হওয়া, ভাষার বিয়ের আয়োজন, এসব আনন্দঘন উৎসবে মুখরিত ছিল শহরের বিভিন্ন প্রাঙ্গণ। ভাষার স্বামী খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী প্রশাসনের ক্যাডার। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের প্রথম পর্যায় থেকেই ভাষা মূলত ঢাকায় অবস্থান করে। ঈদে বা বিভিন্ন ছুটিতে সুনামগঞ্জে আসলে তার পরিচিত সবার বাসায় যায়। মুরব্বিদের খোঁজ খবর নেয়। অর্থাৎ ছোট বেলায় সে যে স্নেহ- মমতায় বেড়ে উঠেছে তা ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বহুগুণে! এরমধ্যে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিমিনোলজির উপর এক বছরে একটি কোর্স সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে প্রায় দুই বছর ইংল্যান্ডে অবস্থান করে। এ সময় তার স্বামী ইংল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন।
ইতিমধ্যে তার সুপ্রীম কোর্টের এনরোমেন্টের পরীক্ষার সময় চলে আসায় নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই দেশে ফিরে আসে সে। সেই পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয় সাফল্যের সাথে। এজন্য সে গর্বিত হয়ে বলেছে, ‘আমার পরিবারে অনেক আইনজীবী, কিন্তু আমি একমাত্র সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী।’ ইতোমধ্যে সে হজ্বব্রত পালন করে ফেলেছে।
বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করার এক অদম্য ইচ্ছে ভাষার ছিল এবং এ কাজ তার স্বল্প পরিসরের জীবনে সে করেও গেছে। মানুষের জন্য তার ব্যয়িত অর্থ, সময় ও শ্রম বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রকাশিত থেকে গেছে। প্রবাসে গিয়েও তার জনসেবা থেমে থাকেনি। সুনামগঞ্জের অনেকেই এখন ইংল্যান্ডে অবস্থান করেছেন। প্রতিদিনই সে খোঁজ খবর নিতে কারো না কারো বাসায় যেত। সঙ্গে করে নিয়ে যেত আনন্দের স্রোতধারা। একবার প্রবাসী আত্মীয়দের কাছে ভাষার প্রবাসের দিনকাল সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানিয়েছিলেন এক অদ্ভুত তথ্য! ভাষা নাকি অবৈধভাবে ইংল্যান্ডে পালিয়ে থাকা সুনামগঞ্জের অনেক তরুণদের জন্য বৃটিশ পাত্রী খোঁজে বের করে তাদের সেদেশে বৈধ করার চেষ্টা করছে! ঢাকায় অবস্থানকালে সে সুনামগঞ্জ সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন কমিটির নেতৃত্বে অবস্থান করেছে। উদ্দেশ্য একটাই। ঢাকাস্থ সুনামগঞ্জবাসির জন্য কিভাবে কাজ করা যায়, সেই চেষ্টা করা।
প্রতি বছরের মতো এবারও সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতি পিকনিকে যায়। এবারের ভেন্যু ছিল সিলেটের জাকারিয়া সিটি। কাকতালীয়ভাবে ঐদিন ছিল ভাষার জন্মদিন। ভাষা সংশ্লিষ্ট কোন সংগঠনের প্রোগ্রাম থাকবে, আর সে এতে অংশগ্রহণ করবে না- তা হতেই পারে না। সে সিলেট থেকে পিকনিকে যোগ দিবে বলে ঘোষণা দিল। শাহানা আপা প্রথমে পিকনিকে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। শেষে ভাষার শক্ত অবস্থানে তিনি পিকনিকে যান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকায় তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয় ফেরার পথে। ভাষার জন্য আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করি সুবিদবাজারে। সে তার স্বামীসহ এসে উপস্থিত হয়েই আমাদের ক্লান্তি দূর করে দেয়। মা মেয়ের দেখা হয়। সেই আনন্দে সে ঝলমল করতে থাকে। কে জানতো এটাই তার জীবনের শেষ জন্মদিন!
প্রায় ৬ মাস আগে সুনামগঞ্জ কোর্টে তার সর্বশেষ উপস্থাপনা ছিল। জেলা জজ আদালতে একজন আসামীর জামিন শুনানী করে সে। প্রসিকিউশন পক্ষে পিপি ভাষার মা শাহানা আপা এবং তার দুই মামা। প্রতিপক্ষের শক্ত অবস্থান দেখে সে কিছুটা বিচলিত হলেও সুন্দর ও সাবলিল উপস্থাপনা দিয়ে ঠিকই আসামীর জামিন মঞ্জুর করিয়ে নেয়। কয়েক মাস আগে সুনামগঞ্জ উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে একটি চমৎকার লিখা তার ফেসবুকে পোস্ট করে। ‘দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর’র সম্পাদক পঙ্কজ দা ভাষার সঙ্গে আলাপ করে তা পত্রিকায় ছেপে দেন। এটিই পত্রিকায় ছাপা তার শেষ লিখা।
আজকে যারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখছেন, সবাই বলছেন ‘আমাদের ভাষা’। সে ছিল সব সংকীর্ণতার উর্ধ্বে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে ভালো জায়গায় অবস্থান করেও তার কোনো অহংকার ছিল না। সবার সঙ্গে নিজে এগিয়ে এসে কথা বলতো। শাহানা আপারা পাঁচ বোন ও এক ভাই। উনাদের বাবা প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও আইনজীবী সোনাহর আলী এক মেয়েসহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। পরবর্তীতে উনার স্ত্রী আমাদের ‘শান্তিফুফু’ এই পরিবারকে আগলে রাখেন অসীম দৃঢ়তায়। আজ শাহানা আপা ছাড়াও জেসমিন আপা (অবসরপ্রাপ্ত সলিসিটর), শাম্মী আপা (জেলা পরিষদের সদস্য), লাকি আপা (স্পেশাল পিপি) ও আবেদীন ভাই (এডিশনাল পিপি, সাধারণ সম্পাদক জেলা শিল্পকলা একাডেমি) স্ব স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত। ভাষার অসুস্থতার খবরে গত কয়েকদিন যাবৎ উৎকন্ঠিত ছিলো সুনামগঞ্জবাসি। মানবাধিকার কর্মী সাকিল আহমেদ- এর কাছ থেকে নিয়মিত খবর রাখতেন অ্যাড. সালেহ আহমদ, আনসারুল হক বাবু, অ্যাড. মাহাবুবুল হাছান শাহীন, অ্যাড. খলিল রহমানসহ আরও অনেকে। মারা যাওয়ায় কয়েক ঘন্টা আগেও অনেকের কথা হয় শাম্মী আপার সঙ্গে। কিন্তু ভোর রাতেই সব খবর চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যায়!
দেশের গড় আয়ুর তুলনায় অর্ধেক জীবন কাটিয়ে চলে গেল আমাদের ভাষা। পারিবারিকভাবেও অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিল সে। মা শাহানা আপার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতো। ছোট ভাইবোন ফজলে রাব্বি স্মরণ ও ডা. কনিজ রেহনুমা কথা এখন বড় হয়ে গেলেও তাদের সবসময় আগলে রাখতো সে। ভাষার স্বামী খন্দকার মুদাচ্ছির অত্যন্ত ভালো ছেলে। ভাষার মতোই নিরহংকার। সদ্য মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। চারদিকে আরও আনন্দের সংবাদ ছিল। এখন কে কাকে সান্তনা দেবে?
ভাষার জানাজা হচ্ছে গ্রামের বাড়ি উজানিগাঁওয়ে। পিতার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে তাকে। কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করে মানুষ গিয়েছেন ভাষার জানাজায়। ভাষারা যদি এভাবে চলে যায়, আমাদের জানাজা পড়বে কারা?
লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর।