যা আছে রিফাত হত্যাকাণ্ডের মামলায়

২৬ জুন বুধবার সকাল ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের প্রধান গেটের সামনে শাহ নেয়াজ রিফাত শরীফকে নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। এ সময় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেও রিফাতকে রক্ষা করতে পারেননি। গুরুতর আহতাবস্থায় রিফাত শরীফকে প্রথম বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল ও পরে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই মৃত্যু হয় রিফাত শরীফের।

এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ১২ জনকে অভিযুক্ত করে অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনকে আসামি করে বরগুনা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- বরগুনা পৌরসভার ডিকেপি রোডের ৯নং ওয়ার্ডের মৃত ছিদ্দিকুর রহমানের ছেলে মো. সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড (২৫), বরগুনা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি রোডের দুলাল ফরাজীর ছেলে মো. রিফাত ফরাজী (২৩) এবং মো. রিশান ফরাজী (২০), বরগুনা পৌরসভার আমতলা পাড় এলাকার চন্দন (২১), বরগুনা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের মো. মুসা, সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া এলাকার কালাম আকনের ছেলে রাব্বি আকন (১৯), বরগুনা পৌরসভার কলেজিয়েট স্কুল রোডের মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), বরগুনা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কেজি স্কুল রোডের রায়হান (১৯), বরগুনা পৌরসভার কলেজ রোডের মো. হাসান (১৯), সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের সোনালী পাড়া এলাকার রিফাত (২০), একই এলাকার অলি (২২), এবং টিকটক হৃদয় (২১)। এছাড়াও মামলায় অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এ মামলার সাক্ষীরা হলেন- নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি, রিফাত শরীফের চাচা আব্দুস সালাম শরীফ এবং আ. আজিজ শরীফ, বরগুনা পৌরসভার কাউন্সিলর মো. রইসুল আলম রিপনের ছেলে মঞ্জুরুল আলম জন, সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের উত্তর বড় লবণগোলা গ্রামের আলতাফ হোসেন হাওলাদারের ছেলে মো. লিটন, একই এলাকার মরহুম আজম আলী মৃধার ছেলে আনোয়ার হোসেন মৃধা, মরহুম আনসার আলী মৃধার ছেলে মো. জাকারিয়া বাবু, মো. রুহুল আমিনের ছেলে মো. হারুন ও মরহুম আলতাফ হোসেন হাওলাদারের ছেলে আ. হাই আল হাদিসহ প্রমুখ।

মামলায় রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ উল্লেখ করেন, ‘আমার ছেলে মো. শাহনেওয়াজ রিফাতের সঙ্গে আনুমানিক তিন মাস আগে বরগুনা পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন মাইঠা গ্রামের মো. কিশোরের মেয়ে এ মামলার ১নং সাক্ষী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির বিবাহ হয়। বিবাহের আগে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির সঙ্গে মামলার ১নং আসামি মো. সাব্বির আহমেদ নয়নের প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে নয়ন দাবি করে। আমার ছেলের সঙ্গে মিন্নির বিবাহের সংবাদ জানার পর থেকে নয়ন এবং তার দলীয় সহযোগী অন্যান্য আসামিরা আমার ছেলে রিফাতকে বিভিন্ন সময় হত্যাসহ নানা রকম ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে।’

mamla

মামলায় দুলাল শরীফ আরও উল্লেখ করেন, ‘এ মামলার ১নং সাক্ষী মিন্নি বরগুনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে লেখাপড়া করে। ঘটনার দিন ১নং সাক্ষী কলেজে যায় এবং ঘটনার তারিখ ২৬/৬/২০১৯ রোজ বুধবার সকাল অনুমান ১০টা দশ মিনিটের সময় আমার ছেলে রিফাত ১নং সাক্ষী মিন্নির সঙ্গে দেখা করতে বরগুনা সরকারি কলেজের গেটের সামনে পৌঁছালে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা সকল আসামিরা এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে আমার ছেলে রিফাতকে ঘিরে ফেলে। এরপর অতর্কিতে ১নং আসামি মো. সাব্বির আহমেদ নয়ন তার হাতে থাকা ধারালো রামদা দিয়ে আমার ছেলে রিফাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘাড় লক্ষ্য করে কোপ দেয়। নয়নের দেয়া সেই কোপ আমার ছেলে রিফাতের গলার ডান পাশে পড়ে গুরুতর হাড় ও রগ কেটে রক্তাক্ত জখম হয়।

নয়ন কোপ দেয়ার পর ২নং আসামি তার হাতে থাকা ধারালো দা দিয়ে আমার ছেলে রিফাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোপ দিলে ওই কোপ রিফাতের বুকের ডান পাশে পড়িয়া গুরুতর জখম হয়। এ সময় ৩নং আসামি তার হাতে থাকা দা দিয়ে আমার ছেলে রিফাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথার উপর কোপ দিয়ে গুরুতর জখম করে।

অন্যান্য আসামিরা আমার ছেলের শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ অবস্থায় আমার ছেলে রিফাতকে গুরুতর আহতাবস্থায় রেখে আসামিরা ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। এরপর মামলার ১নং সাক্ষী ঘটনাস্থলে উপস্থিত কিছু লোকের সহায়তায় আমার ছেলে রিফাতকে রিকশায় করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে এবং কর্তব্যরত ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে মোবাইল ফোনে সংবাদ পেয়ে আমি আমার ভাই ও অন্য সাক্ষীদের নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে আসি এবং রিফাতকে গুরুতর আহতাবস্থায় দেখতে পাই। এ সময় রিফাতের মুখে আমি ঘটনার বিবরণ শুনি।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য আমার ছেলে রিফাতকে মৃতপ্রায় অবস্থায় বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। এ সময় এ মামলার দুই ও তিন নম্বর সাক্ষীদ্বয় রিফাতকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। এরপর ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আমার ছেলে রিফাত মারা যায়। আসামিদের ধারালো অস্ত্রের কোপের কারণেই মূলত আমার ছেলে মৃত্যুবরণ করে, যা একটি হত্যার অপরাধ। আমার পুত্রশোকে কাতর থাকা আসামিদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে এ মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হয়। আমার ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য এবং বহু সাক্ষী প্রমাণ আছে।’

এদিকে রিফাত হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার তিনজনকে শুক্রবার বিকেলে আদালতে হাজির করে চন্দন ও মো. হাসানের ১০ দিন এবং নাজমুল আহসানের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। পরে আদালত শুনানি শেষে চন্দন ও মো. হাসানের সাতদিন এবং নাজমুল আহসানের দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

প্রসঙ্গত, ২৬ জুন বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশাকে বরগুনা সরকারি কলেজে নিয়ে যান রিফাত। কলেজ থেকে ফেরার পথে মূল ফটকে নয়ন, রিফাত ফরাজীসহ আরও দুই যুবক রিফাত শরীফের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে তারা। রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই হামলাকারীদের থামানো যায়নি। তারা রিফাত শরীফকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন রিফাত শরীফকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে রিফাত শরীফের মৃত্যু হয়।