ট্রিবিউন কেন এই বানোয়াট সংবাদ প্রচার করেছে পরের দিনের ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের প্রতিক্রিয়া থেকে তা বোঝা যাবে। নয়াদিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, কিছু কট্টরপন্থী ওই মন্দির ভাঙার দাবি তোলে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা না দিয়ে বরং ‘অবৈধ জমির ব্যবহারের’ অজুহাতে মন্দির ভাঙার অনুমতি দেয়। দেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় ভারতের সহযোগীর ভূমিকায় রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পদ ও উপাসনালয়ের ওপর হামলা চালানোর যে ভিত্তিহীন প্রচারণা গোদি মিডিয়ার পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে, তারা তাদের সহযোগী। এর আগেও বেশ কিছু ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত মূল ধারার বেশির ভাগ মিডিয়ার বিচারে জুলাই আন্দোলনকারীরা ছিল দাঙ্গাবাজ, নাশকতা সৃষ্টিকারী। এত দ্রুত হাসিনার পতন ও পালানোর ঘটনা ঘটেছে যে, বিপ্লববিরোধিতার প্রমাণ মিডিয়া লুকাতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের ৩৬ দিনের পত্রিকা ও টিভির কনটেন্ট সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। একটি দেশের মিডিয়া তার জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বিরোধী এমন নজির বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই।
পটপরিবর্তনের পর সেইসব মিডিয়া পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হলেও তাদের মনে আওয়ামী বন্দনা ও ভারতীয় বয়ানের রোগ রয়ে গেছে। এর বহু আলামত তাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভারতীয়দের সংখ্যালঘু কার্ডের পক্ষে লাঠিয়াল হওয়া। বিপ্লবের পর এক বছর সময়ে অনেকবার বাংলাদেশী মিডিয়া মিথ্যা বানোয়াট সংবাদ করে ভারতের মিডিয়া ও সরকারকে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার করার সুযোগ করে দিয়েছে।
গত ২৪ জুন বাংলা ট্রিবিউন ঢাকায় মন্দির ধ্বংসের হুমকি সম্পর্কিত একটি খবর প্রকাশ করে। পত্রিকাটি লিখেছে, রাজধানীর খিলক্ষেতে দুর্গা মন্দিরঅপসারণে সময় বেঁধে দিয়েছে কিছু মুসল্লি। মুসল্লিদের একটি মিছিল থেকে এ আলটিমেটাম দেয়া হয়। মুসল্লিরা জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার মধ্যে মন্দির সরিয়ে নেয়া না হলে তারা মন্দির ভেঙে ফেলবেন।
ট্রিবিউন কেন এই বানোয়াট সংবাদ প্রচার করেছে পরের দিনের ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের প্রতিক্রিয়া থেকে তা বোঝা যাবে। নয়াদিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, কিছু কট্টরপন্থী ওই মন্দির ভাঙার দাবি তোলে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা না দিয়ে বরং ‘অবৈধ জমির ব্যবহারের’ অজুহাতে মন্দির ভাঙার অনুমতি দেয়। দেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় ভারতের সহযোগীর ভূমিকায় রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পদ ও উপাসনালয়ের ওপর হামলা চালানোর যে ভিত্তিহীন প্রচারণা গোদি মিডিয়ার পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে, তারা তাদের সহযোগী। এর আগেও বেশ কিছু ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দিনাজপুরে হিন্দু নেতা ভবেশকে অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার বানোয়াট খবরটি কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই ছেপে দেয় ডেইলি স্টার। ভারতীয় মিডিয়ার জন্য এই খবর হটকেক হয়। স্টারের খবরের পরপরই ভারত এটিকে ইউনূস সরকারের পদ্ধতিগত সংখ্যালঘু হত্যার আরেকটি নৃশংস নজির বলে বিবৃতি দেয়।
পরে তদন্তে দেখা যায়, এর সাথে সংখ্যালঘু হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। পোস্টমর্টেম ও সুরতহাল রিপোর্টে আঘাতের কোনো চিহ্ন তার শরীরে ছিল না। ভিসেরা রিপোর্টে বলছে, তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়নি। সাম্প্রদায়িক কারণেও সে হত্যার শিকার হয়নি। ফ্যাক্ট চেক করে দেখা গেছে, সাংবাদিক নামধারি একটি চক্র পরিকল্পিত উপায়ে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমকে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে খবর করতে খুব উৎসাহী দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র বানিয়ে ভারত ব্যবহার করতে পারে এমন খবর প্রচারে কেন মিডিয়ার এত প্রবল উৎসাহ সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে।
ডেইলি স্টার খবরটি পরে সংশোধন করে নেয়। বাংলা ট্রিবিউনও পরে খবরটি সংশোধন করে। ভারত ঠিক যে ধরনের খবর চায় তার চাহিদা কিন্তু এর মধ্যে পুরনো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের ওপর যতটা চাপ প্রয়োগ করার সেটি করা হয়েছে।
ভবেশের হত্যা ও খিলক্ষেতে মন্দির ধ্বংসের মতো শত শত ভুয়া নিউজ ড. ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশী মিডিয়া ভারতের অনুকূলে অগ্রাধিকার দিয়ে করেছে। এ পর্যন্ত একটি ভুয়া সংবাদের জন্যও মিডিয়া হাউজগুলোকে জবাবদিহি করতে হয়নি। কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। এভাবে দেশের মিডিয়া হাউজগুলো দেশবিরোধী কিছু অপরাধীর আশ্রয়স্থল হিসেবে অপব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছে এক উন্মুক্ত হাতিয়ার, যা ভারতের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জুলাই বিপ্লব নিয়ে ভারত সরকার ও দেশটির মিডিয়ার একটি অংশের মনোভাব বিস্ময়কর। হাজার হাজার মানুষের আত্মদান ও লাখ লাখ মানুষের ত্যাগ স্বীকারকে তারা একেবারে গুরুত্বহীন মনে করে। একে তারা মৌলবাদের উত্থান, আইএসআইয়ের ভেল্কিবাজি কিংবা লস্কর-ই তৈয়বার অপারেশন বলে উড়িয়ে দিতে চায়। বাস্তবে জুলাইতে বাংলাদেশে যা ঘটেছে শত বছরেও এমনটি ঘটেনি। বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের যে নজির সৃষ্টি হয়েছে তার দ্বিতীয় উদাহরণ এই উপমহাদেশে নেই। একসাথে সারা দেশের কোটি কোটি মানুষ ফ্যাসিবাদী হাসিনা শাসনের বিরুদ্ধে এই সময় রাস্তায় নেমে এসেছিল। ৫ আগস্ট ঢাকার তিন কোটি মানুষের প্রায় সবাই রাস্তায় জড়ো হয়েছিল। এ ধরনের গণ-আন্দোলনের মর্ম বুঝতে পারার ক্ষমতা ভারতীয় শাসক ও তাদের মিডিয়ার নেই অথবা তারা তা বুঝেও না বোঝার ভান করছে।
প্রায় এক বছর ধরে ড. ইউনূস সরকারের সাথে বৈরিতার পর ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, তারা বাংলাদেশের সাথে সব ধরনের আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র যখন এই ঘোষণা দিচ্ছেন, সেখানেই খিলক্ষেতে মন্দির ভাঙার ভুয়া খবর নিয়েও প্রতিক্রিয়া দিলেন তিনি। বানোয়াট মিথ্যা খবরের ওপর ভিত্তি করে সরকারের মুখপাত্র বক্তব্য দেন, এমন নজির অন্য কোনো দেশে সচরাচর দেখা যায় না। ভারত তাদের এই ভুল নিয়ে কখনো দুঃখ প্রকাশ করেনি। ভুল ধরা পড়ার পর সেটি শোধরে নিতে তাদের দেখা যায় না। বারবার তারা একই ভুল করে যাচ্ছে। প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের একটি দেশের সরকারি দফতর কিভাবে ক্রমাগত ভুল করতে পারে বোঝা মুশকিল। ভারতীয়দের জন্য সুবিধাজনক দিক হলো, তারা আমাদের প্রকাশ্যে শত্রুতা করলেও আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ আবার ভারতের ঘোরতর সমর্থক। বিশেষ করে মিডিয়ার একটি অংশ। ভারত যদি পুরো বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেয় তবুও তারা কিভাবে ভারতের পথে হাঁটবে। একসময় আর কে মিশন রোড থেকে প্রকাশিত একটি পুরনো পত্রিকা এখন কাওরান বাজার থেকে বের হয়। এটি ভারতীয় স্বার্থের খবর সবার আগে জায়গা করে দেয়। দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বাংলাদেশের সাথে সব বিষয়ে আলোচনায় প্রস্তুতির খবরটি প্রথম পাতায় তারা গুরুত্বের সাথে দিয়েছে। তাতে খিলক্ষেতে কথিত মন্দির ভাঙার প্রতিক্রিয়াও যত্নের সাথে ছেপেছে। কিন্তু মন্দির ভাঙার খবরটি যে সম্পূর্ণ ভুয়া- তা উল্লেখ করেনি। এতে করে পত্রিকাটির পাঠকরা জানবে, খিলক্ষেতে অন্তর্বর্তী সরকার একটি মন্দির ভাঙার সহযোগী হয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়ার বড় একটি অংশ এভাবে ভারতের পক্ষ থেকে আসা উদ্দেশ্যপূর্ণ বানোয়াট বয়ান প্রচারে সহযোগিতা করে আসছে।
২৮ জুন পত্রিকটি যখন ভারতীয় মুখপাত্রের প্রতিক্রিয়া গুরুত্ব দিয়ে ছাপে, সেই একই দিনে দুই জেলার সীমান্ত দিয়ে ৪৫ জনকে পুশইন করার খবরটি পত্রিকাটির প্রথম বা শেষের পাতায় ছাপার উপযুক্ত বিবেচনা করেনি। অথচ এই খবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক এগুলো জানতে উদগ্রীব। সিলেটের জৈন্তাপুর দিয়ে ১৪ রোহিঙ্গাসহ ৩১ জন এবং মৌলভীবাজারের বড়লেখা দিয়ে ১৪ জনকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী পুশইন করে। গত কয়েক মাস শত্রুতা করার এই নতুন ধরন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছে ভারত। একসাথে দেশের সব সীমান্ত দিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের আহ্বান করা হয়েছে, কোনো বাংলাদেশী নাগরিক ভারতে থেকে থাকলে তাদের যেন সরকারি পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠান হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আপত্তি নেই। এই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ভারত ক্রমাগত অবৈধভাবে পুশইন চালিয়ে যাচ্ছে। যেসব রোহিঙ্গা ভারতে শরণার্থীর মর্যাদা পেয়েছে, ভারতীয় নাগরিক যাদের আধার কার্ড আছে এমন লোকদেরও কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে পুশইন করা হচ্ছে। এ সময় তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো এবং খাবার না দেয়ার অভিযোগ উঠছে। কাউকে কাউকে তারা বন-জঙ্গলে এমনকী জনহীন প্রান্তরে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে।
নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারে ভুয়া খবরের পিছে ছুটছে মিডিয়া
সংবাদ প্রকাশ করে সেটি প্রত্যাহার করার শীর্ষে রয়েছে দৈনিক প্রথম আলো। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ডেইলি স্টার। ভুয়া, অসত্য বা বানোয়াট খবর মূল ধারার গণমাধ্যমে বেশি করে জায়গা পাচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন ও পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর প্রবণতা থেকে ভিত্তিহীন খবর তারা ছড়াচ্ছে। পিআইবি আয়োজিত এক সেমিনারে এক গবেষণা প্রবন্ধে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক অপতথ্যের গতি-প্রকৃতি শিরোনামে গবেষণাটি করা হয়। এই খবরটি প্রথমদিন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে দেখা যায়নি। তবে তার পরের দিন এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে প্রথম আলো। পত্রিকাটির সহায়তায় এগিয়ে এসেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিআইবিও।
পত্রিকা দু’টি পতিত আওয়ামী লীগকে নরমালাইজ করার চেষ্টা ক্রমাগত করে যাচ্ছে। ড. রেহমান সোবহানকে দিয়ে বিস্তারিত লিখিয়েছে দলটিকে নির্বাচনে আনার ব্যবস্থা না করলে কত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে তা নিয়ে। এরপর দেখা গেল, ডেভিড বার্গম্যানকে দিয়ে একই ধরনের লেখা তারা প্রচার করছে। আওয়ামী লীগ যে ভয়াবহ অপরাধ করছে সেদিকে তারা নজর দিতে নারাজ। গুম খুন গুপ্ত কারগার তৈরি করার অপরাধের বিচার হলে হাসিনাসহ দলটির কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। পত্রিকা যুগল চায় জাতির বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ মার্জনা করে দলটিকে নির্বাচনের সুযোগ করে দিতে।
সংবাদ প্রকাশ করে তা প্রত্যাহারের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে কালবেলা, তৃতীয় ইত্তেফাক। এই প্রতিযোগিতায় আরো রয়েছে যথাক্রমে- ঢাকা পোস্ট, বাংলা ট্রিবিউন, বিডি নিউজ। বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রায় সবগুলোকে এই তালিকায় এক কাতারে পাওয়া যাচ্ছে। গবেষণার কিছু দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূল ধারার সংবাদমাধ্যম যে নীতি-নৈতিকতা মেনে চলে না, সেটি পরিষ্কার। কিছু ক্ষেত্রে তারা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধেও চলে যায়। দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্ততপক্ষে সংখ্যালঘু ইস্যুতে প্রকাশিত সংবাদ তার প্রমাণ।