বিশেষ প্রতিবেদক,শাল্লাঃ
আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও অবহেলায় সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। এ অনিয়মে জড়িত ১৮০ জনের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রয়েছেন। ইতোমধ্যে দু’জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ওএসডি করা হয়েছে পাঁচজনকে।
প্রকল্পের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ২২ জেলার ৩৬টি উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকরা তদন্ত কমিটি করেছেন। সেসঙ্গে সব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিদর্শন দলের সদস্যরা। তাদের প্রতিবেদনে ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, বরগুনার আমতলী, বগুড়ার শেরপুর, শাজাহানপুর, হবিগঞ্জের মাধবপুর, সুনামগঞ্জের শাল্লা ও মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলায় ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা ও দুর্নীতির ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। গত রবিবার সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ইউএনওর দায়িত্ব পালন করে আসা শফিকুল ইসলামকে ওএসডি করা হয়েছে। বরগুনার আমতলীর ইউএনও আসাদুজ্জামানকে ওএসডি করা হয়েছে গত সোমবার। এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
এ ছাড়া বগুড়ার শেরপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে আসা লিয়াকত আলী সেখকে গত রবিবার ওএসডি করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ সদরে ইউএনওর দায়িত্ব পালন করে আসা রুবায়েত হায়াত শিপলু ওএসডি হয়েছেন গত সোমবার। মুন্সীগঞ্জ সদরে কর্মরত সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিন ওএসডি হয়েছেন গত সোমবার। এই উপজেলার প্রকৌশলী, সংশ্নিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাবেক ইউএনও মাহমুদা পারভীন, হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার সাবেক ইউএনও তাসনুভা নাশতারান, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ইউএনও আল-মুক্তাদির হোসেনকে ওএসডি এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিক তদন্তে এ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণে অনিয়ম করার ঘটনার সঙ্গে ৩৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকদের জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া আরও ২৯টি উপজেলায় ঘর নির্মাণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- বগুড়ার আদমদীঘি, কুমিল্লার দেবিদ্বার, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, মাদারীপুরের কালকিনি, লালমনিরহাট সদর, গাজীপুরের শ্রীপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, জামালপুরের ইসলামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, ময়মনসিংহ সদর, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, ভোলার লালমোহন, পাবনার সাঁথিয়া, মানিকগঞ্জের ঘিওর, নাটোর সদর, কুড়িগ্রামের রৌমারী, বরিশাল সদর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘর নির্মাণের বেলায় নীতিমালা মানা হয়নি। অনেক ঘরে নির্মাণে ক্রটি রয়েছে, গুণগত মান ঠিক হয়নি। ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। পিলার ভেঙে গেছে। দেয়াল ধসে পড়েছে। ঘর নির্মাণে ব্যবহূত মালামালও ছিল নিম্নমানের। নিচু এলাকায় ঘর নির্মাণ করায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ভূমির মালিকরাও ঘর বরাদ্দ পেয়েছে।
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা অনুযায়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হলেন ইউএনও। অন্য চার সদস্য হলেন- সহকারী কমিশনার (ভূমি), এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী, সংশ্নিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। ঘর নির্মাণে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে তাদের সার্বিক দায়দায়িত্ব নিতে হবে। একজন ইউএনও এবং অন্য তিন কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪৪ জন কর্মকর্তা এবং ৩৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছেন।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন সমকালকে জানিয়েছেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীনকে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ জন্য সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তারা তদন্ত কমিটির মাধ্যমে অভিযোগ তদন্ত করছেন। কেউ কেউ প্রতিবেদনও দিয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বগুড়ার শেরপুরে কায়রাখালী বাজারের কাছে খালের পাড়ে নির্মিত ঘরগুলো এখন ভাঙনের সম্মুখীন। অতিবৃষ্টির কারণে সাতটি ঘর ধসেও পড়েছে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ঘরের হিসাবে গরমিল পাওয়া গেছে। সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা এই বিষয়ে হিসাব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। মুন্সীগঞ্জ সদরে নকশা ও প্রাক্কলন অনুযায়ী ঘর নির্মাণ করা হয়নি। কয়েকটি ঘর কিছুদিন আগে ভরাট করা খালের কাছে তৈরি করা হয়েছে। এতে ওই ঘরগুলো ধসে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
একই অর্থবছরে বরগুনার আমতলীতে নির্মিত ঘরের গুণগত মান ঠিক হয়নি বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সেসঙ্গে ভূমিহীনদের ঘর ভূমি মালিকদের নামে বরাদ্দ, ঘর বরাদ্দে অনিয়ম এবং ঘর নির্মাণ নিয়ে নীতিমালাবর্হিভূত কর্মকাণ্ড করার অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় ডিজাইন বর্হিভূতভাবে ঘর নির্মাণ এবং পার্শ্ববর্তী উপজেলায় ঘর নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বগুড়ার শাজাহানপুরে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গায়। এর ফলে ৯টি ঘর বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ ঘরগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী।
হবিগঞ্জের মাধবপুরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে। এ ছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নোয়াখালীর হাতিয়ায় নির্মিত অনেক ঘরের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। নেত্রকোনায় ঘরের দেয়াল ধসে গেছে। নারীঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বরিশালের বানারীপাড়ায় ভূমিহীনের ঘরের পিলার ভেঙে ফেলার হয়েছে। এ নিয়ে মামলাও চলছে। অবশ্য ভেঙে ফেলা ঘর আবারও নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
ঘর নির্মাণ নিয়ে বেনামে চিঠি দিয়েও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ, একটি অসাধু চক্র ঘর বরাদ্দের বেলায় টাকা নিয়েছে। সচ্ছল ব্যক্তিরা ঘর পেয়েছেন। সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এ অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আবার সচ্ছল ব্যক্তিকে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলে জানা গেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্মিত ঘরের পিলারসহ বিভিন্ন অংশের ছোটখাটো ক্রটিবিচ্যুতি জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করে দেওয়া হয়েছে। যে সব ঘরে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে, সেটা আশ্রয়ণ প্রকল্পের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের পরিদর্শন টিমের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছেন। সে অনুযায়ী সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্ল্নোগান হলো, ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। এর সঙ্গে আমাদের সবার আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ক্রটিবিচ্যুতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৈথিল্যের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। অনিয়ম ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি পেতেই হবে। কাউকেই বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যম হলো সমাজের দর্পণ। আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম হলে তারা অবশ্যই সেটা প্রচার করবেন। পরবর্তী সময়ে সেই অনিয়ম শুধরিয়েও নেওয়া হবে।
তবে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়ানোর জন্য গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব।
আশ্রয়ণ ২-এর প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, প্রকল্পটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের প্রকল্প। ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে এই প্রকল্পটি মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ধরনের অনিয়ম ও অবহেলা সহ্য করা হবে না। তা ছাড়া দুর্নীতি দমনে শূন্য সহনশীলতা অনুসরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। তাই আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রস্তুত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওর নেতৃত্বে সহকারী কমিশনার (ভূমি), এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী, সংশ্নিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা করোনাভাইরাস পরিস্থিতি উপেক্ষা করে মাঠ পর্যায়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। এটি সাধুবাদযোগ্য।
সূত্র : সমকাল
দৈনিক দিরাই শাল্লা
১১:২৫ অপরাহ্ণ