ডেস্ক নিউজঃ
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দু বসতিতে হামলার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ১১ জনকে বদলি এবং ছয়জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। ২৬ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনটির পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশের অংশটুকু যুগান্তরের হাতে এসেছে।
হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসকে ঘিরে ১৭ মার্চ মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে হামলা চালানো হয়। প্রায় ৮৫টি ঘরে তাণ্ডব চালায় হামলাকারীরা। এ ঘটনার বেশ কয়েক দিন পর সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। কমিটির অপর সদস্য হলেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি অপারেশনস-১ মো. আয়ুব। পরে ডিআইজি মফিজ উদ্দিন ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসাকে তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ২৪ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন। এ ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাদের কী ধরনের গাফিলতি ছিল তা তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ অংশে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দিরাই সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সুফিয়ান ১৩ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে পুলিশ কমান্ডো কোর্সের প্রশিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ২১ মার্চ তিনি দিরাই যোগদান করেন। কিন্তু হামলার ঘটনায় করা মামলায় আসামিদের গ্রেফতারে তার বিশেষ কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি।
সুনামগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীনের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার সময় তিনি দিরাই সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি, কোনো পদক্ষেপও নেননি। প্রতিবেদনে বলা হয়-সুনামগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) হিসাবে কর্মরত সাহেব আলী পাঠান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও আসামি গ্রেফতার ও মামলা তদারকিতে তার কোনো বিশেষ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি। সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা এড়াতে শাল্লা থানার ওসি বিশেষ প্রতিবেদন পাঠিয়ে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ১৬ ও ১৭ মার্চ পর্যন্ত সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা তিনি নেননি।
ঘটনার আগে ও পরে শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হক (সাময়িক বরখাস্ত ও বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত) পুলিশ সুপারকে অবহিত করেন। ঘটনার আগের দিন রাতে দরাইন বাজার ও নোয়াগাঁও এলাকায় ডিউটিতে পাঠানো কথা থানার পিসিসিতে উল্লেখ করা হলেও একই পুলিশ দলকে সুনামগঞ্জের অন্য পিসিসিতে পাঠানো হয়। পুলিশ মোতায়েনের যে প্রমাণপত্র তিনি তৈরি করেছিলেন তা বিভাগীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি ও অসদাচরণমূলক। রাতেই স্ট্যাটাসদাতাকে গ্রেফতারের পর শাল্লা থানার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। এ দায় ওসি নাজমুল এড়াতে পারেন না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে দিরাই থানার ওসি আশরাফুল ইসলামের (মৌলভীবাজার জেলায় বদলি) দায়িত্ব অবহেলার কথা বলা হয়েছে। হামলাকারীদের অধিকাংশই ছিল দিরাই থানা এলাকার। দিরাই থেকে হামলাকারীরা গেলেও তাদের প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি ওসি আশরাফুল আগাম তথ্যও সংগ্রহ করেননি। হামলার খবর শুনেও পাশের থানার ওসি হিসাবে তিনি সঠিক সময়ে সাড়া দেননি।
শাল্লা থানার ডিউটি অফিসার এসআই আমির খসরুরও গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, একই দিনে দুই পিসিসিতে স্বাক্ষর করে একই পুলিশ দলকে দুটি ভিন্ন স্থানে ডিউটিতে পাঠিয়েছেন তিনি। কাজটি কিভাবে করেছেন তার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। দায়িত্ব এড়ানোর জন্য তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন যা বিভাগীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি ও অসদাচরণ। এ ছাড়া প্রতিবেদনে জেলা বিশেষ শাখার ডিআইও-১ নিরস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন মৃধা, দিরাই জোনের ডিআইও এসআই হারুন-অর-রশিদ, ওয়াচার কনস্টেবল ইমরান আহমেদ, শাল্লা জোনের ডিআইও এএসআই সৈয়দ মুর্শিকুর রহমান আগাম তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছেন। সবকিছু পর্যালোচনা শেষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সুফিয়ানকে বদলি করার মতামত দিয়েছেন তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে শাল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ নাজমুল হককে তদন্তসংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন না করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। দিরাই থানার অফিসার ইনচার্জ আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন না করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। একইভাবে সুনামগঞ্জ জেলা বিশেষ শাখার পরিদর্শক ডিআইও-১ আনোয়ার হোসেনকে অন্যত্র বদলির সুপারিশ করা হয়েছে। এসআই আমির খসরু ও এসআই হারুন অর রশিদ, এএসআই মুর্শিকুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। ওয়াচার কনস্টেবল ইমরান আহমেদকে অন্যত্র বদলির সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া এ ধরনের হামলা ঠেকাতে সব ধর্মবর্ণের লোকজনকে নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর ধর্মীয় সম্প্রীতি সমাবেশ আয়োজনসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।