ডেস্ক রিপোর্টঃ সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের গৃহস্থরা পড়েছেন বেকায়দায়। চাষাবাদের মৌসুম শুরু হলেও জমি পাতানো (রংজমা দেওয়া) যাচ্ছে না এবার। উৎপাদনের খরচের চেয়ে ধানের দাম কম থাকায় বর্গা চাষীরা জমি চাষাবাদে আগ্রহী নয়। উপায় না পেয়ে গৃহস্থরা অর্ধেকেরও কম টাকায় জমি রংজমা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ অনুরোধ করে এভাবে জমি বর্গা দিচ্ছেন, ‘জমি চাষ করো, যা পারো দিও’। এই অবস্থা পুরো হাওরাঞ্চলজুড়ে। এভাবে চলতে থাকলে হাওরের গৃহস্থ এবং প্রান্তিক কৃষকরা জীবিকার তাগিদে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
গত বছর সুনামগঞ্জে ধানের চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ১৭ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে, আবাদ হয়েছিল দুই লাখ ২৪ হাজার ৪০ হেক্টর। উৎপাদন হয় ১৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ মে.টন ধান।
১১ উপজেলা ও মধ্যনগর থানা মিলে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল মাত্র ১৭ হাজার ৮২৩ মে.টন এবং চাল আতব কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৭৯৮ মে.টন এবং সিদ্ধ ১৪ হাজার ১৭৯ মে.টন। প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা অর্থাৎ প্রতি মণ ধান ১০৪০ টাকা করে কেনা হয়। চাল আতব ৩৫ টাকা এবং সিদ্ধ কেনা হয় ৩৬ টাকা কেজিতে। লক্ষমাত্রা মোতাবেক ধান-চাল কিনে জেলা খাদ্য বিভাগ।
সরকার ধান চাল কম কেনায় এবং খোলাবাজারে ধানের দাম কম থাকায় ধানের দাম
সারা বছরই কম ছিল। হাওরাঞ্চলে কার্তিক মাসের এই সময়েও (৯ নভেম্বর’২০১৯) ধানের দাম সাড়ে ৫ শ’ থেকে সাড়ে ছয়’শ টাকা মণ। ধানের ক্রেতাই পাওয়া যাচ্ছে না। ধানের দামের এই অবস্থায় বেকায়দায় পড়েছেন গৃহস্থরা (কৃষকরা)।
দিরাই উপজেলার উদগল হাওরের হাসিমপুর গ্রামের কৃষক সঞ্জয় কান্তি রায় বলেন, আমার প্রায় ৬ একর জমি আছে, বেশ কয়েক বছর ধরে চাষবাস ছেড়ে দিয়েছি। গত বছর সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার টাকা দরে রংজমা দিয়েছিলাম। এবার অনেক কষ্টে এক হাজার দু’শ টাকা করে রংজমা দিয়েছি।
শাল্লার ডুমরা গ্রামের নৃপেন্দ্র দাসের ৫ একর জমি। তিনি নিজে এক একর চাষ করেন, বাকীটা রংজমা দেন।
নৃপেন্দ্র বললেন, ‘কয়েকজনরে কইছি কেউ রাজি অয় না, জমি পাতাইতাম পাররাম না, লইতাছে না কেউ, গতবার প্রতি একর পাতাইছলাম ৯ হাজার টেকায়, ইবার ৩ হাজার টেকায়ও নের না। ইলা অইলে গ্রাম ছাড়ি দেওন লাগবো, ইখানো থাইক্কা পেট বাছাইতাম পারতাম নায়।’
একই গ্রামের রবীন্দ্র চন্দ্র সরকার বললেন, ধানের দাম কম থাকায় ই-বার খুব কষ্ট কইরা চলছি। জমিন আছে ৬ একর। এক-দুই একর নিজে করি, বাকীটা রংজমা দেই। এখন পর্যন্ত চেষ্টা করেও রংজমা দিতে পারি নি। কেউ জমি কিনছেও না। রোয়ার সময়ও চলে আসছে। রংজমা দিতে না পারলে জমি পতিত থাকবে।
তারিহরপুরের শনির হাওরপাড়ের ভাটি তাহিরপুরের বর্গাচাষী ইউনুস আলী জানালেন, জমি বর্গা নিয়ে বা রংজমায় এনে চাষাবাদ করে চলার মতো নয়। এর চাইতে শরীর খাটিয়ে অন্যভাবে রোজগার ভাল হয়। তার দেওয়া হিসাব মতে, এক একর জমি চাষাবাদ করতে কমপক্ষে ১৫ কেজি বীজ লাগবে, এই বীজর দাম ১৫০০ টাকা, হালের খরচ ১৫০০ টাকা, ৯ জন মজুরের খরচ ৪৫০০ টাকা, বন পরিস্কার করা ৩০০০ টাকা, কাটানো কমপক্ষে ৪৫০০ টাকা। খরচের এই ১৫ হাজার টাকা তুলতে ৩০ মণ ধান পাওয়া লাগবে। শনির হাওরে একরে ৩৬ মণের বেশি ধান হয় না। তাহলে খরচে চলে গেলো ৩০ মণ ধান, ঘরে ওঠলো ৩৬ মণ ধান। এতো কম আয়ে কোনভাবেই চলা সম্ভব নয়। অন্য যেকোনো কাজ করলে, এর চেয়ে বেশি আয় হয়। এজন্য তিনি এবার রংজমার কিংবা বর্গার জমি কোনটাই করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, তার গ্রামে ৩৩ পরিবার কৃষক ছিল। ৬ পরিবার আছে যাদের কৃষি ছাড়াও অন্যভাবে উপার্জন আছে। অন্যরা যারা কৃষির উপর নির্ভরশীল, তারা গ্রাম ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার দাবি এই অবস্থা পুরো হাওরজুড়ে। এবার বেশিরভাগ বর্গাচাষী বর্গা করবে না, কারো জমি রংজমায় এনেও চাষ করবে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক সফর উদ্দিন বলেন, আমার নেত্রকোণা জেলায় বাড়ি, হাওরের ভালো অংশে কিছু জমি ছিল আমার। অন্যবছর প্রতি একরে ২০ হাজার টাকা রংজমা দিয়েছি। এবার দেওয়া লাগছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায়। তার দাবি সরকার এই অবস্থা থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য ভর্তুকি দেবার উদ্যোগ নিয়েছে। ৭০ ভাগ ভর্তুকিতে ধান কাটার যন্ত্র এবং আগামী মৌসুম থেকে ধান রোপনের যন্ত্রও ৭০ ভাগ ভর্তুকিতে দেওয়া হবে।