সংগ্রহে- শান্ত কুমার তালুকদার
বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি উজ্জ্বল একটি তারিখ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় ঘটে। সেদিন এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘এ বিজয় সেদিন পূর্ণতা পাবে, যেদিন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত স্বদেশে ফিরে আসবেন।’ আমাদের বিজয়ে সেই পূর্ণতা নিয়ে আসে ১০ জানুয়ারির দিনটি।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এর আগেই তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর ইয়াহিয়া খান তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে বিচারের প্রহসন চালান। মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসনের ভাষ্য অনুযায়ী, ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে উত্তরসূরি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সেটি কার্যকর করতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
২০ ডিসেম্বর খণ্ডিত পাকিস্তানের দায়িত্ব নিয়ে ভুট্টো পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে সিহালা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে একটি যোগসূত্র রক্ষা করার আহ্বান জানান। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আগে আমাকে আমার জনগণের কাছে যেতে দাও। তাদের সঙ্গে কথা না বলে আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না।’
এরপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৭ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে পিআইএর একটি বিশেষ বিমান ইসলামাবাদ ত্যাগ করে। যাত্রাপথে বিমানটি করাচি থেকে কামাল হোসেনের স্ত্রী ও দুই মেয়েকে তুলে নেয়। ৮ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ছয়টায় বিমানটি হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ভিআইপি লাউঞ্জে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।
কিছুক্ষণ পর বাংলাদেশ মিশনের তিন কূটনীতিক পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী ব্রিটেনের ডেপুটি হাইকমিশনার এম এম রেজাউল করিম, মহিউদ্দিন আহমদ ও মহিউদ্দিন জোয়ারদার সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। রেজাউল করিমের গাড়িতেই বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজ’স হোটেলে পৌঁছান। বিবিসির সকালের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আসার খবর প্রচারিত হলে লন্ডন ও আশপাশের এলাকা থেকে বহু বাঙালি সেখানে ভিড় জমান এবং ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দেন। তিনি দোতলা থেকে হাত নেড়ে তাঁদের শুভেচ্ছার জবাব দেন।
ক্ল্যারিজ’স হোটেলের বলরুমে বেলা একটায় এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্বের সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন এক অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা।’
একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি দেশে না ফিরে লন্ডনে এলেন কেন?’ বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, ‘আপনি কি জানেন না যে আমি বন্দী ছিলাম। পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছেতেই আমাকে লন্ডনে পাঠানো হয়।’ ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁর সরাসরি বাংলাদেশে আসা সম্ভব ছিল না। ভুট্টোর জীবনীকার স্ট্যানলি ওলপার্টের ভাষ্য, ভুট্টো মুজিবকে ইরান বা তুরস্কে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে লন্ডনকে বেছে নেন।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। যুদ্ধ শেষে এ দাবি আরও জোরালো হয়। কোনো কোনো গণমাধ্যম তাঁর মুক্তির দাবি জানানোর পাশাপাশি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে। ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ গার্ডিয়ান তাদের সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। কেবল শেখ মুজিবুর রহমান এই অবনতি রোধ করতে পারেন। তাঁকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে এক দিনও দেরি করা ঠিক হবে না।’ পত্রিকাটি ৪ জানুয়ারি সংখ্যায় লেখে, ‘তাঁকে (শেখ মুজিবকে) হত্যা করা বা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দী রাখা হলে বাংলাদেশের সরকার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারাত্মক নেতৃত্বসংকটের মুখোমুখি হতো। তাঁর মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।’
হঠাৎ করেই খবর প্রচারিত হয়, মুজিব মুক্তি পাচ্ছেন।
৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আসার খবর পেয়ে তিনি দ্রুত লন্ডনে ফিরে আসেন। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। হিথ স্বীকৃতির বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন। সন্ধ্যার পর বিরোধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসনও ক্ল্যারিজ’স হোটেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেদিনই ব্রিটেনে ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান। তাতে বলা হয়, ‘আপনি বন্দী ছিলেন, কিন্তু আপনার চিন্তাশক্তি ও চেতনাকে কারারুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। আপনি নির্যাতিত জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।’ তিনি দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করারও অনুরোধ জানান।
৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার জন্য ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডন ত্যাগ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসার জন্য বিমান পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকারের বিমানেই দেশে ফিরতে চাইলেন। লন্ডন থেকে তাঁর সফরসঙ্গী হন ভারতের দুই কূটনীতিক, ভেদ মারওয়া ও শশাঙ্ক ব্যানার্জি।
১০ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (বর্তমানে ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর) পৌঁছালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁকে স্বাগত জানান।
দিল্লির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার মানুষের কাছ থেকে যখন আমাকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো, তাঁরা কাঁদছিলেন। আমি যখন কারাগারে, তারা তখন চালিয়েছিল সংগ্রাম। আর আমি যখন ফিরছি, তারা বিজয়ী। কেননা তাঁর এই জয়যাত্রা ছিল অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিত্ব থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়।’
১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিন সারা দেশে আনন্দের জোয়ার বইছিল। ঢাকার রাজপথ লোকারণ্য। কেউ বিমানবন্দরে গিয়েছেন নেতাকে একবার দেখতে, কেউ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছেন, কেউবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছেন তাঁর ভাষণ শুনতে। এই উদ্যানেই তিনি ১০ মাস আগে একাত্তরের ৭ মার্চ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’
রবার্ট পেইন তাঁর ম্যাসাকার বইয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ জানুয়ারির জনসভার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গণহত্যার অবসান হয়েছিল, দখলদারদের পরাভব ঘটেছিল, শুরু হয়েছিল নতুন জীবন, উজ্জীবিত হচ্ছিল নতুন আশা। সেই রৌদ্রালোকিত দিনে দূরের এক শহরে রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চে দাঁড়ানো এক ঋজু ব্যক্তি, দুনিয়ার সব নিপীড়িতজনের জন্য বয়ে এনেছিলেন আশা।’
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। নতুন রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
এরপর শুরু হয় দেশ পুনর্গঠনে তাঁর দুরূহ যাত্রা। দুর্গম পথচলা।
টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারির সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলে, গত অর্ধশতাব্দীতে মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ উপমহাদেশের ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাবসঞ্চারী নেতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন; তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি নাম: শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ, তথা মুজিব বর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হলো এই মহান নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস দিয়েই। দিনটি শুধু পাকিস্তানি বন্দিশিবির থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরা নয়, এ দেশের ইতিহাসেরও যুগান্তকারী মোড় ফেরা।
সূত্র- প্রথম আলো সহ বিভিন্ন পত্রিকা