কাউসার চৌধুরী:
হাওরাঞ্চলবাসীর বহুল প্রত্যাশিত শাল্লা-জলসুখা ওলওয়েদার সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম বর্ষায়ও থেমে নেই। মূল সেতু ছাড়াও ৩টি সেতু ও ২৩টি কালভার্ট স্থাপনের জন্যে ভরা বর্ষায় সয়েল টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। ভবিষ্যতে কালভার্টের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়-এজন্যে করা হতে পারে পাইলিংও। মাস-দুয়েকের মধ্যে এ প্রকল্পে শুরু হবে সিলেট অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ৮০০ মিটার দীর্ঘ সেতুর কাজ। কৃষি কাজ যাতে ব্যাহত না হয় এজন্য সাবমার্জিবল (ডুবন্ত) কালভার্ট দেয়ারও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের ইটনা -মিঠামইন সড়কের আদলেই এই সড়কটি নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। এতে ব্যয় হবে ৭৬৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সওজ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০১৯ সালের ২০ আগস্ট মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপির প্রচেষ্টায় একনেকে পাশ হয় বৃহৎ এই প্রকল্পটি।
সওজ সিলেটের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উৎপল সামন্ত সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, প্রকল্পটি সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। দু-অংশে ৫টি সেতু ও ৩৬টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। কৃষকরা যাতে সড়কের দু’পাশে নির্বিঘ্নে জমিজমা করতে পারেন-এ জন্যে কালভার্টের নীচে সাবমার্জড কালভার্ট দেয়া হবে। যাতে নির্বিঘ্নে জমিতে পানি দিতে পারেন। বৈশাখে জমির ধান বাড়ীতে নিতে পারেন। এজন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শাল্লা-জলসুখা সড়কের গরমখাল ও কান্দিগাঁও এলাকায় ৭৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে দু’টি এবং ভাটগাঁও এলাকায় ৬২ মিটার দৈর্ঘ্যরে আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হবে। শাল্লার অংশে ২৩টি ও আজমিরীগঞ্জ অংশে ১০টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। এ সকল কালভার্ট যাতে বর্ষায় তীব্র স্রোতেও ভেঙে কিংবা হেলে না যায়-এজন্য সয়েল টেস্ট করা হয়। প্রকল্প এলাকায় শক্ত বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে নৌকা দিয়ে করা হয় সয়েল টেস্ট। ইতোমধ্যে ১০টি সয়েল টেস্ট ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আজকালের মধ্যে এগুলোর প্রতিবেদন চলে আসার কথা রয়েছে। বাকিগুলোর টেস্ট পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন সওজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাসুম আহমদ । তিনি জানান, মূল সেতুর কাজ এখনো শুরু হয়নি। আগামী মাস-দুয়েকের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প এলাকার প্রকৌশলী সোহেল আহমদ জানান, জলসুখা এলাকায় ৪৪৪ মিটার দীর্ঘ সেতুর পাইলিং কাজ শুরু হয়েছে। ৮০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে মূল সেতুর কাজ যতদ্রুত সম্ভব শুরু হয়ে যাবে। বর্তমানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ২৫০ জনেরও বেশি শ্রমিক মালামাল আনলোডের কাজ করছেন। প্রকল্প এলাকায় মেশিনারি আনার কাজ চলছে। মাস দেড়েক পর পানি কমলে হয়তো পুরোদমে কাজ করা যাবে।
সুনামগঞ্জ-দিরাই-শাল্লা-আজমিরীগঞ্জ-হবিগঞ্জ মহাসড়ক বাস্তবায়নের জন্যে নির্মাণ করা হচ্ছে শাল্লা-জলসুখা সড়ক। হাওরের মাঝ দিয়ে ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজার থেকে ভাটগাঁও-কান্দিগাঁও হয়ে হাওরের মধ্য দিয়েই জলসুখা পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে সড়কটি। প্রকল্পের আওতায় কুশিয়ারা নদীর উপর নির্মাণ করা হচ্ছে ৮০০ মিটার দৈর্ঘ্য গার্ডার সেতু। এটি হবে সিলেট অঞ্চলের সর্ববৃহৎ সেতু। এতো দৈর্ঘ্যরে সেতু ইতোপূর্বে সিলেট অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়নি। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শাল্লা গ্রামের দক্ষিণ থেকে এবং হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুরের উত্তর প্রান্তে নির্মিত হচ্ছে সর্ববৃহৎ এই সেতু।
দিরাই-শাল্লা সরাসরি সড়ক যোগাযোগ এক সময় কল্পনায় থাকলেও এটি বাস্তবায়নের জন্যে দিরাই-শাল্লার আমৃত্যু সংসদ সদস্য, উপমহাদেশের প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সোচ্চার হন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রচেষ্টায় ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দিরাই-শাল্লা সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দিরাই থেকে শাল্লা উপজেলা সদর ঘুঙ্গিয়ারগাঁও পর্যন্ত ৪৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সড়ক নির্মাণে ৯১ কোটি টাকা ব্যয় করে সওজ। তবে সড়কটির এখনো পূর্ণতা পায়নি। তবে, দিরাই -শাল্লা সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন করতে আরেকটি নতুন প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সড়কটির নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়। তবে, সময়মতো প্রকল্প অনুমোদন ও কাজ শুরু না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও বাড়বে বলে সওজ সূত্র জানিয়েছে।
সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছে, সড়কটি নির্মাণের ফলে হাওরাঞ্চলের পর্যটনে বিপ্লব সাধিত হবে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন সড়ক দেখতে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। ওই সড়কের মতোই নির্মাণ হবে শাল্লা-জলসুখা সড়ক। হাওরের মধ্য দিয়ে এটি সিলেট অঞ্চলের প্রথম সড়ক বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সওজ সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক জানিয়েছেন, বর্ষায়ও প্রকল্পের কাজ চলছে। ২৩টি কালভার্টের সয়েল টেস্ট করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে কালভাট গুলোর কোনো ক্ষতি না হয়-এজন্যে সয়েল টেস্ট করা হয়। প্রয়োজনে পাইলিংও করা হতে পারে। মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আমরা তাদের নির্দেশনার আলোকে সড়কটি নির্মাণ করছি। পানির জন্য মূল কাজ করা যাচ্ছে না। পানি কমে গেলেই প্রকল্প বাস্তবায়নে পুরোদমে কর্মযজ্ঞ শুরু হবে বলে জানান এ প্রকৌশলী।