রুদ্র মিজান, কেজাউরা থেকে ফিরে | কেজাউরা। ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আলোচিত গ্রাম। থানা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে এখন নিস্তব্ধ, নীরবতা। চাপা আতঙ্ক মানুষের মধ্যে। এই গ্রামেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে পাঁচবছর বয়সী শিশু তুহিনকে। হত্যার অভিযোগ উঠেছে শিশুর বাবাসহ স্বজনদের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা। হত্যাকাণ্ড নিয়ে রা’ নেই গ্রামের মানুষের মুখে।
কিছু জানতে চাইলে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন তারা। নিষ্পাপ শিশুকে নৃশংসভাবে কেউ হত্যা করতে পারে? এই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। প্রশ্ন রয়েছে পুলিশের তদন্ত নিয়েও। একপাশে পিচঢালা সড়ক, অন্যপাশে সুরমা নদী। মৃত সুরমা হিসেবেই পরিচিত। গ্রামের মধ্য দিয়ে, নদীর কূলঘেষে ইটবিছানো পথ। এই সড়কেই ছিলো জমাট বাঁধা রক্ত। সড়কের পাশে কদমগাছে ঝুলানো ছিলো তুহিনের লাশ। প্রায় তিন সহস্রাধিক মানুষের এই গ্রামে মারধরের ঘটনা ঘটলেও ২০০২ সালের আগে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। ২০০২ সালের পর এ পর্যন্ত তুহিনসহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে চারটি। থানা পুলিশ ও আদালতে দৌঁড়াতে হচ্ছে গ্রামের মানুষকে।
কেজাউরা গ্রামে শিক্ষার হার ১০ ভাগেরও কম। দরিদ্র কৃষক পরিবারের বাস এখানে। হাতে গুনা কয়েক পরিবার অর্থ-বিত্তের মালিক। গ্রামটি বারবার আলোচনায় এসেছে হত্যাকাণ্ডের জন্য।গত ১৪ অক্টোবর চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে শিশু তুহিন। তার কান, পুরুষাঙ্গ কেটে দুটি ছুরি পেটে ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয় গাছের সঙ্গে। এই গ্রামে কথা হয় এখানকার বাসিন্দা ও তুহিনের স্বজন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে। যে বাড়ির কদমগাছে ঝুলানো ছিলো তুহিনের লাশ, এর মালিক ইব্রাহিম, হারুন, দুলাল তিন ভাই। ঘটনাস্থল থেকে তাদের ঘর প্রায় ৫শ’ গজ দুরে। ইব্রাহিম মিয়া জানান, ফজরের নামায পড়তে মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরমধ্যে কান্নার শব্দ। বের হয়ে দেখতে পান তুহিনের লাশ ঘিরে মানুষের ভীড়। ঘটনাস্থল থেকে কয়েক বাড়ি পরে তুহিনের বাবা আব্দুল বাছিরের ঘর। ঘরের পশ্চিমে প্রতিপক্ষ আব্দুল হামিদ ও নুর উদ্দিনের ঘর। সরু গলি দিয়ে ঢুকতে হয় বাছিরের ঘরে। পৈত্রিক এই ঘরে থাকেন দরিদ্র বাছির, মছব্বির, নাছির, জাকিরুল ও মরহুম ইসলাম উদ্দিনের পরিবার।
ঘরের সামনের দরজা বরাবর কক্ষে সে রাতে ছিলেন বাছিরের দুই ভাতিজি। এরমধ্যে নবম শ্রেণির ছাত্রী তানিয়া রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে ঘুম ভাঙ্গলে দেখতে পান দরজা খোলা। দরজার পাশেই অন্য কক্ষে থাকা চাচা বাছিরকে ডাকেন। বাছির জানান, রাত আড়াইটার দিকে প্রস্রাব করতে বাইরে গেলেও দরজা বন্ধ করেছিলেন। এরমধ্যেই তুহিন কোথায়, বলে চিৎকার করেন বাছির। ঘরের ভেতরে খুঁজেন। তারপর আশপাশ। কোথাও নেই। ইতিমধ্যে প্রতিবেশী এক যুবকও অংশ নেয় খোঁজখুঁজিতে। প্রায় ৪টার দিকে তুহিনের লাশ দেখতে পান তারা। খবর পেয়ে সকাল ১০টার দিকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এক পর্যায়ে গ্রেপ্তার করা হয় তুহিনের বাবা বাছির, চাচা নাছির ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ারকে।
ইতিমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন নাছির ও শাহরিয়ার। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই এই হত্যাকাণ্ড। শাহরিয়ারের মা খাইরুন নেছা দাবি করেছেন, নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি অদায় করেছে পুলিশ। ১৫ বছর বয়সী শাহরিয়ার ওই রাতে মায়ের সঙ্গেই ঘুমিয়েছিলো। তুহিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে মা খাইরুন নেছাই তাকে ডেকে তোলেন। তাদের ধারণা পেশাদার কোনো কিলার ভাড়া করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হতে পারে। কিন্তু কারা, কেন ঘটাবে এই হত্যাকাণ্ড? প্রতিপক্ষের সঙ্গে যখন বিরোধ প্রায় নিষ্পত্তির পথে ঠিক তখনই নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে।
স্বাধীনতার পর এই গ্রামে প্রথম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ২০০২ সালের ২২শে জুন। তবে সেটা গ্রামের প্রতিপক্ষের মধ্যে না। নারী সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন পাশের মধুপুর গ্রামে মুজিবুর রহমান মুজিব নামে এক ব্যক্তি। বিচারাধীন এই মামলায় চার্জ গঠন হয়েছে তিন আসামির বিরুদ্ধে। তার মধ্যে রয়েছেন তুহিনের বাবা আব্দুল বাছির।
গ্রামের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ২০০৮ সালে। সাবেক ইউপি মেম্বার আনোয়ার হোসেনের চাচাতো ভাই জবর আলীকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যার অভিযোগে মামলা করা হয় তুহিনের বাবা বাছিরের পক্ষের লোকজনের বিরুদ্ধে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে হত্যার বিষয়টি প্রমাণিত না হওয়া ও সাক্ষ্য প্রমাণ না পেয়ে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। পরে মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত। ওই মামলায় দীর্ঘদিন হয়রানির শিকার হয় বাছির পক্ষ, এতে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে।
২০১৫ সালে জলমহাল নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে খুন হন বাছির পক্ষের তরুণী নিলুফা বেগম। ঘটনাটি ঘটে প্রকাশ্যে গ্রামের রাস্তায়। এই মামলায় দুই দফা আনোয়ার হোসেনসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হয়। প্রথম দফা পুলিশ। দ্বিতীয় দফায় সিআইডি। বিচারধীন এই মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন আনোয়ার হোসেনসহ তার লোকজন। বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছেন। গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি আনোয়ার হোসেন। একটি কোম্পানীর প্রায় ৭০ লাখ টাকার চেক ডিজঅনার মামলায় সম্প্রতি কারাগারে ছিলেন তিনি। চাঞ্চল্যকর তুহিন হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগে কারাগার থেকে বের হন আনোয়ার। মুজিব হত্যাকাণ্ডে গ্রামে কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ মুজিবের বাড়ি অন্য গ্রামে। জবর আলীর মৃত্যুর বিষয়টি হত্যা প্রমাণিত না হওয়ায় মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এ নিয়েও তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে নিলুফা বেগম হত্যাকাণ্ডের বিরোধ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ওই মামলার আসামি আনোয়ার হোসেনের পক্ষের শিহাব উদ্দিন জানান, নিলুফা বেগম হত্যা মামলাটি আপোস হওয়ার পথে ছিলো। ১২ লাখ টাকা দিলে বাদি পক্ষ আপোস করতো। এরকম একটা সমাধানের পথ ছিলো। কিন্তু এতো টাকা আমরা পাব কোথায়? এরমধ্যেই তুহিন হত্যাকাণ্ড ঘটে।
দুই পক্ষের মামলা, বিরোধ থাকলেও অভিযোগ উঠেছে তুহিন হত্যাকাণ্ডে প্রতিপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে সুনামগঞ্জ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। লাশ উদ্ধার করে তুহিনের পরিবারের সদস্যদের থানায় ডেকে নেন। ১৫ই অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে মিজানুর রহমান বলেন, পুলিশের কাছে শিশু তুহিন হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন চাচা ও চাচাতো ভাই ,হত্যার ঘটনায় সুনামগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তুহিনের চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার। ১৪ই অক্টোবর রাত আড়াইটার দিকে বাবা আব্দুল বাছির তুহিনকে কোলে করে ঘরের বাইরে নিয়ে যান। পরে চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার তুহিনকে খুন করেন। তুহিনের কান ও লিঙ্গ কেটে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পেটে ছুরিবিদ্ধ করে রাখা হয়। সেই ছুরিতে কলমের কালিতে আনোয়ার হোসেনের লোক ছালাতুল ও সোলায়মানের নাম লেখা ছিলো। গ্রামের মসজিদে কথা হয় ছালাতুলের সঙ্গে। তিনি জানান, তাকে ফাঁসাতে কেউ ছুরিতে নাম লিখেছে। হত্যাকাণ্ডের পর গ্রামে পুলিশ এলেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। জব্দকৃত ছুরিতে হাতের ছাপ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ঢাকায় সিআইডি’র ল্যাবে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, দুই সপ্তাহের মধ্যেই পরীক্ষা সম্পন্ন করে রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে।
নিহত তুহিনের পরিবারের প্রতিপক্ষের নেতা আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি কারাগার থেকে বের হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে। কারা, কেন করেছে কিছুই বুঝতে পারেননি। তবে তুহিনের চাচা ও চাচাতো ভাই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে শুনেছেন তিনি। তুহিন হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিনের মধ্যে আনোয়ার হোসেনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। তিনি বলেন, যাদের সন্দেহ করা হয়েছে তাদের শুরুতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, তদন্তের প্রয়োজনে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ দরকার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ছুরির মধ্যে হাতের ছাপ ও পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। তদন্তাধীন বিষয়ে এরচেয়ে বেশি মন্তব্য করা ঠিক হবে না বলে জানান তিনি।