পি সি দাশ, শাল্লা ঃ
হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের বোরো ধান কাটার মওসুমে প্রতিবছরই শ্রমিক সমস্যায় ভোগেন কৃষকরা। সংকট কাটাতে সরকারি উদ্যোগে হাওরে হাওরে পৌঁছেছে হারভেস্টার মেশিন (ধান কাটার মেশিন)। তাতেও শান্তি নেই কৃষকের। জেলার ২৩৮টি হারভেস্টার মেশিনের ৫১ টি-ই বিকল। সংশ্লিষ্ট কোম্পানীগুলোর সার্ভিস প্রদানের অনিহার অভিযোগও আছে। আবার হারভেস্টার মেশিনগুলোও ধান কাটতে টাকা বেশি নিচ্ছে এমন অভিযোগও আছে হাওর এলাকায়।
জেলার শাল্লা উপজেলার ফয়জুল্লাপুরের বাসিন্দা কৃষক লালচান মিয়া ও আনিছুর রহমান মিলে ৩ বছর আগে সাড়ে ৫ লাখ টাকায় একটি হারভেস্টার মেশিন কিনেছিলেন।
এসিআই কোম্পানীর দিরাইয়ের পরিবেশক কৃষ্ণ রায়ের মাধ্যমে এই হারভেস্টার মেশিন কিনেছিলেন শাল্লার ফয়জুল্লাপুরের এই দুই কৃষক।
লালচান মিয়া জানালেন, দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে কেনা এই হারভেস্টার মেশিন দিয়ে প্রথম বছর সামান্য কিছু বোরো জমির ধান কর্তন করেছিলেন। এরপর থেকেই মেশিনে কাজ করছে না। হারভেস্টার মেশিনের চালককে বসিয়ে রেখে বেতন গুনতে হয়েছে।
লালচান মিয়া ও আনিছুর রহমান জানালেন, কোম্পানীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পর কদ্দুছ মিয়া নামের একজন প্রকৌশলীকে পাঠিয়েছিল, সেও মেরামত করতে পারে নি।
এসিআইয়ের দিরাই উপজেলা পরিবেশক কৃষ্ণ রায় জানালেন, লালচান মিয়ার হারেভেস্টার মেশিন কাজ করছে না এমন কথা আমাদের জানান নি।
জানালে অবশ্যই আমরা মেরামত করে দেবার ব্যবস্থা করবো। এখন যেহেতু শুনেছি, তিনি না বললেও আমরা যোগাযোগ করে এটি মেরামত করে দেব।
শাল্লা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বললেন, লালচান মিয়া ও আনিছুর রহমান বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন, আমি এই বিষয়ে কোম্পানীর পরিবেশক ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলবো।
কৃষক লাল চান মিয়া ও আনিছুর রহমানের হারভেস্টার মেশিন ছাড়াও জেলাজুড়ে বিভিন্ন কোম্পানীর ৫১টি হারভেস্টার মেশিন কাজ করছে না জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা।
শাল্লার আঙ্গারুড়া নোয়াগাঁওয়ের বড় কৃষক মাখন লাল দাশ বললেন, এত টাকার ধান কাটার মেশিন এভাবে (হারভেস্টার) নষ্ট হয়ে পড়ে থাকলে কিনতে কিভাবে সাহস করবেন কৃষকরা।
অন্যদিকে, হারভেস্টার মেশিনওয়ালারা ধান কর্তন করতে বেশি টাকা নেবারও অভিযোগ ওঠেছে এলাকায়। ছায়ার হাওরপাড়ের মামুদনগর গ্রামের বড় কৃষক হাবিবুর রহমান হবিব বলেন একর প্রতি ধান কর্তনে হারভেস্টার মেশিন ওয়ালারা ১৮’শ থেকে দুই হাজার টাকা নিলে ন্যায্য হয়, দিনে ৮ একর জমির ধান কাটতে পারে একটি হারভেস্টার মেশিন। প্রতি একর দুই হাজার টাকা করে নিলে ১৬ হাজার টাকা আয় করতে পারে দিনে। হারভেস্টার ওয়ালারা প্রতি একর ধান কর্তন করতে চার হাজার পাঁচ’শ টাকা নিচ্ছে। এটি কিভাবে মানা যায়। এই টাকায় শ্রমিক দিয়েই ধান কাটানো সম্ভব।
তিনি জানালেন, বিষয়টি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন। কৃষি কর্মকর্তা বলেছেন, সোমবারই হারভেস্টার মেশিনের মালিকদের ডেকে ধান কর্তনের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানানো হয়, এই বিষয়ে কোন অভিযোগ পাওয়া যায় নি। তবুও হারভেস্টার মালিকদের ডেকে তারা যাতে টাকা বেশি না নেন, সেই অনুরোধ জানাবো।
কৃষি অফিসের দায়িত্বশীলরা জানান, শাল্লাসহ হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের কৃষকদের ধান কাটা মাড়াইয়ের কাজের আধুনিকায়নের জন্য যন্ত্রের উপর ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এই ভর্তুকিতে ধান কাটার হারভেস্টার মেশিন ৭০ শতাংশ ছাড় দেয়া হচ্ছে। মেশিনটির মূল্য ৩০ থেকে ৩৩ লাখ টাকা হলেও ভর্তুকিতে কৃষক পাচ্ছেন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায়।
কৃষকরা বলছেন, এসব মেশিনের স্থায়িত্ব কম। কয়েক বছর পরই মেশিন বিকল হয়ে যাচ্ছে। এই মেশিন ঠিক করতেও অনেক টাকা প্রয়োজন। নতুন মেশিন ভর্তুকিতে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায় পাওয়া যায়। নষ্ট হওয়া মেশিন ঠিক করতেও অনেক সময় ১০-১২ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। যেখানে নতুন মেশিন ১০-১২ লাখ টাকায় পাওয়া যায়, সেখানে এতো টাকা খরচ করে পুরোনো মেশিন ঠিক করতে চান না কৃষকরা।
হাওরাঞ্চলে বৈশাখ মাসে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শিক্ষিত যুবক যুবতীরা তাদের পরিবারের কৃষি কাজে যোগ দিয়েছেন। অনেকে আবার নিজেদের হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কেটেছেন। সুখলাইন গ্রামের কাজল দাস বললেন, ৩০ থেকে ৩৩ লাখ টাকার মেশিন ৩- ৪ বছর পর নষ্ট হলে কৃষকের আরও লোকসান। তার মতে, হারভেস্টার মেশিন সঠিকভাবে চালানো না জানার কারণে এরকম সমস্যার তৈরি হচ্ছে। কৃষক এই দামি মেশিন চালাতে জানেন না। এজন্য কম সময়ে এসব মেশিন নষ্ট হচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে সবার। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মেশিনটি চালানোর ব্যাপারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দাবী জানান।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, ২৩৮টি হারভেস্টার মেশিন সচল রয়েছে। আমাদের কাছে রয়েছে ১১টি। এছাড়াও ৫১টি মেশিন অচল হয়ে আছে। মেশিনগুলো সচল করতে যে টাকা প্রয়োজন সে টাকা দিয়ে কৃষক নতুন মেশিন কিনতে পারে। এজন্য কেউ অচল মেশিনগুলো ঠিক করে সচল করতে চায় না। তিনি বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে হারভেস্টার মেশিনওয়ালারা বেশি টাকা যাতে না নিতে পারে পুরো জেলায় কৃষি কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের নজর রাখার নির্দেশ দেব।