মানব জাতির ইতিহাসে মানুষের উপর মানুষের নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ আর অত্যাচারের বৈধতার জন্য যত অজুহাত রয়েছে বর্ণবাদ তার মধ্যে অন্যতম। একই মানব সমাজের সদস্য হয়েও শ্বেতাঙ্গ মানুষগুলো কেবল গায়ের রংয়ের কারণে অশ্বেতাঙ্গদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে। উনবিংশ শতকে এই দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে বিবর্তনবাদ ও সায়েন্টিফিক রেসিজম কে ব্যবহার করা হয়েছে। শ্বেতাঙ্গদেরকে শীর্ষে রেখে সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে কয়েক ভাগে বিভক্ত বলে প্রচার করা হয়। এই আধিপত্যকামী বর্ণবাদ পশ্চিমা সমাজের গভীরে শিকড় গেঁথে আছে। বর্ণবাদ কখনো শ্বেতাঙ্গ মানুষকে কালো মানুষ বেচাকেনার লাইসেন্স দিয়েছ। আবার কখনো এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় বাদামী আর কালো চামড়ার মানুষদের সভ্যকরণের দায়িত্ব দিয়েছে। বিনিময়ে সাদা মানুষ পেয়েছিল অবাধ লুণ্ঠন আর শোষণ-নির্যাতনের অধিকার। ইউরোপীয় ‘এনলাইটেনমেন্ট’ এর আলো সাদা মানুষের চোখে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে আলোকিত করে তুলতে পারেনি। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-স্বাধীনতা-ভ্রাতৃত্ব অথবা আমেরকিান মানবাধিকারের উচ্চ আদর্শগুলো কালো মানুষকে তার জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। তাইতো আধুনিক সভ্যতার উন্মুক্ত রাজপথেও প্রকাশ্য দিবালোকে নি:শ^াস ব›ধ হয়ে আসে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের। তার ঘাড়ে চেপে বসে হাজারো বছরের পুরোনো শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ। বাতাসে অনুরণিত হয় তার আর্তচিৎকার: “আই ক্যান্ট ব্রিদ”। পুলিশের হাতে খুন হওয়া কৃষ্ণাঙ্গদের মিছিলে জর্জ ফ্লয়েড একা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী চার কোটির কিছু বেশি যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ। মিনিয়াপলিস অঙ্গরাজ্যে এই হার প্রায় ২০ শতাংশ। অথচ ৩ জুন ২০২০ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মিনিয়াপলিসে পুলিশি নৃশংসতার শিকার মানুষদের প্রায় ৬০ ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। পুরো যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও কমবেশি অনুরূপ। অর্থাৎ একজন শে^তাঙ্গ আমেরিকানের চেয়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গের পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ৩ গুণ বেশি। পুলিশি নিষ্ঠুরতার বাইরে সমাজের অন্যান্য স্তরেও বর্ণবাদী বৈষম্য ছড়িয়ে আছে। আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করার পর দেড়শত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এত বছর পরও কালো মানুষ শিক্ষা, চাকরিসহ সমাজের নানা ক্ষেত্রে ‘সিস্টেমেটিক রেসিজম’ (সামাজিক বর্ণবাদ) এর শিকার। সাম্প্রতিককালে ইউরোপ ও আমেরিকায় উগ্র ডানপন্থী ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী দল ও গোষ্ঠীগুলোর উত্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ। আর অধিকাংশ মুসলিমই হলো অশে^তাঙ্গ। ফলে বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়া মিলে প্রত্যেক অশে^তাঙ্গ মানুষকে সম্ভাব্য আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। উপরে বর্ণিত চিত্র মানব সমাজে বিদ্যমান অনাকাক্সিক্ষত বিভাজনকেই ফুটিয়ে তুলে। কিন্তুগত ২৫ মে মিনেসোটার মিনিয়াপলিসে ১৭ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ হাইস্কুল ছাত্রী ডার্নেলা ফ্রেজার যখন জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ভিডিও মোবাইলে ধারণ করছিল সে হয়ত তখন ভাবেওনি এটা বর্ণবাদী বিভাজনের ভিত ও ইতিহাসকে এতটা শক্তভাবে নাড়া দিতে পারে। ১০ মিনিট ৯ সেকেন্ডের ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড দেওয়ার পর মুহুর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। জর্জ ফ্লয়েডের ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য নাড়া দেয় পুরো আমেরিকাকে। ক্ষোভে ফুঁসে উঠে প্রতিটি মানবিক হৃদয়। প্রতিবাদের ঝড় উঠে নিউ ইয়র্ক থেকে সান ফ্রান্সিসকো, মিয়ামি থেকে সিয়াটল প্রতিটি শহরে। মারণব্যাধি কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের ভয়কে উপেক্ষা করে লাখো মানুষ বিক্ষোভে শামিল হয়। আন্দোলন প্রশমনে ব্যর্থ হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রশাসন ৪০ টিরও বেশি শহরে কারফিউ জারি করে। এরই মধ্যে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ আটলান্টিক পার হয়ে ইউরোপের মাটিতে এসে পড়ে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে দাউ দাউ করে জ¦লে উঠে ছোটবড় প্রত্যেকটি নগর-মহানগর। অল্পসময়ে এই বিক্ষোভ সমগ্র দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকায় পুলিশ সংস্কারের দাবি উঠে বেশ জোরেশোরে। এমনকি পুলিশের ফান্ডিং বন্ধ করে দেয়ারও দাবি উঠে। ফলশ্রুতিতে গত ১৯ জুন মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদে পুলিশ জবাবদিহিতা আইন, ২০২০ পাস হয়। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঠিক এক মাস পর গত ২৫ জুন তার নামে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে “জর্জ ফ্লয়েড জাস্টিস ইন পুলিশিং এক্ট” নামে পুলিশ সংস্কার বিল পাস হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ক্রমবর্ধমান পুলিশি নৃশংসতার প্রতিবাদে ২০১৩ সালে “ব্লাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলনের সূচনা হয়। বিগত সাত বছরে মাঝেমধ্যেই এ আন্দোলন দানা বাঁধলেও জর্জ ফ্লয়েড এর মৃত্যু তাতে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও ঘটনার প্রতি সম্মান দেখাতে আমেরিকা-ইউরোপের নগর-মহানগরে অসংখ্য মূর্তি, স্মৃতিস্তম্ভ ও সৌধ স্থাপিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দাস ব্যবসয়ী, বর্ণবাদী, উপনিবেশবাদী আর সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত ব্যক্তিদের মূর্তিও আছে। আন্দোলনের শুরুতেই এসব মূর্তিও সৌধ বিক্ষুদ্ধ জনতার রোষানলে পড়ে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, নিউ জিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে একের পর এক মূর্তিউচ্ছেদ হতে থাকে। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধে দাসপ্রথার পক্ষে যুদ্ধকারী কনফেডারেট নেতা ও কমান্ডারদের মূর্তি উচ্ছেদের মাধ্যমে এর সূচনা হয়। বিক্ষোভকরীরা সর্বপ্রথম ৩১ মে আলাবামা রাজ্যের বার্মিংহামে শহরটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কনফেডারেট নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস লিন এর মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। পরবর্তী সপ্তাহে কনফেডারেট জেনোরেল রবার্ট এডওয়ার্ডলি, এডমিরাল রাফায়েল সিমেস ও তরুণ সৈনিক স্যাম ডেভিস এর মূর্তিগুলো উপড়ে ফেলা হয় অথবা সরিয়ে নেওয়া হয়। ওয়াশিংটন ডিসিতে জেনোরেল আলবার্ট পাইকের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে আন্দোলনকারীরা। এছাড়াও ৫০ টির বেশি কনফেডারেট স্মৃতিস্তম্ভ ও সৌধ ভেঙ্গে ফেলা হয়। ১৩ জুন কনফেডারেট প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিস এর মূর্তিও সরিয়ে নেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা কনফেডারেট জেনোরেলদের নামে থাকা সামরিক ঘাঁটিগুলোর নাম পরিবর্তনের দাবিও তুলেছে। আমেরিকার আদিবাসীদের নির্যাতন ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের কারণে কুখ্যাত অনেক সেটলার ও খ্রিস্টান মিশনারীর মূর্তিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ইতালির নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের সূচনাকারী হিসেবে সারা দুনিয়ায় পরিচিত। কিন্তুআদিবাসীদের গণহত্যা-নির্যাতন ও দাসদাসী হিসেবে বেচাকেনার কারণে কুখ্যাতি রয়েছে তার। আন্দোলন চলাকালে মিনেসোটা, ভার্জিনিয়া, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়াসহ আমেরিকার ১৫ টিরও বেশি রাজ্যে বিক্ষোভকারীরা কলম্বাসের মূর্তিও সৌধ উপড়ে ফেলে দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সর্বশেষ গত ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে বাল্টিমোর শহরে স্থাপিত কলম্বাসের মূর্তি ভেঙ্গে ভাগারে ফেলে দিয়েছে। বর্ণবাদের অভিযোগে আমেরিকার প্রায় অর্ধ-ডজন প্রেসিডেন্টের নাম ও মূর্তি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটি থেকে আমেরিকার ৩য় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের মূর্তিসরিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আমেরিকান ন্যাশনাল হিস্টোরি মিউজিয়ামের সামনে থেকে ২৬তম প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের মূর্তিসরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্ণবাদী বিশ^াস ও নীতির কারণে ২৮ জুন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভবন থেকে প্রথম বিশযুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের নাম মুছে দেয়া হয়েছে। হোয়াইট হাউসের সামনে অবস্থিত ৭ম প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসনের মূর্তি ভাংচুর করেছে বিক্ষোভকারীরা। এমনকি ১৯ জুন ওরেগনে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ওয়াশিংটনের মূর্তিও ভেঙ্গে দিয়েছে বিক্ষুদ্ধ জনতা। বর্ণবাদ ও দাসপ্রথার সমর্থক হওয়ায় অন্যান্য অনেক ব্যবসায়ী, নেতা ও জেনারেলদের মূর্তিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে আমেরিকায় এখন পর্যন্ত শতাধিক মূর্তি ও স্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আমেরিকার পাশাপাশি দাসপ্রথার সূতিকাগার ইংল্যান্ডেও বর্ণবাদী বক্তিদের মূর্তি উচ্ছেদ শুরু হয়েছে। ১৮৯৫ সালে ব্রিস্টল শহরে সপ্তদশ শতকের দাস ব্যবসয়ী এডওয়ার্ড কোলস্টনের মূর্তিস্থাপন করা হয়। গত ৭ জুন বিক্ষোভকারীরা তা উপড়ে পাশের ভাগাড়ে ফেলে দেয়। পরদিন লন্ডনের ওয়েস্ট ইন্ডিয়া ডকে স্থাপিত দাস ব্যবসয়ী রবার্ট মিলিগানের মূর্তিভাংচুর করা হয়। গণদাবির মুখে ৯ জুন তা সরিয়ে নেয়া হয়। ১১ জুন দাস ব্যবসায়ী স্যার জন কাস ও স্যার রবার্ট ক্লেটন এর মূর্তিও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও দাস ব্যবসায়ী, বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যক্তিদের স্মৃতি মুছে ফেলার দাবিতে আন্দোলন চলছে। পক্ষে বিপক্ষে চলছে তুমুল বিতর্ক। অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে স্থাপিত রয়েছে দাস মালিক ও সাম্রাজ্যবাদী সিসিল রোডস এর মূর্তি। গত ১৯ জুন অক্সফোর্ড অরিয়েল কলেজের ছাত্ররা তার মূর্তিসরানোর পক্ষে ভোট দিয়েছে। নন্দিত ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডলরিম্পল বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে থেকে ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনাকারী রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি অপসারণের যুক্তি দিয়ে ১১ জুন গার্ডিয়ান পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে খোদ বৃটেনেই যাকে লর্ড ভালচার (লর্ড শকুনি) বলে ডাকা হয়। বিবিসির ২০০২ সালের এক জরিপে সর্বকালের সেরা বৃটিশ নিবাচিত হয়েছেন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা ও বিশ^াসের। বৃটিশ শাসিত বাংলায় ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে (পঞ্চাশের মন্বন্তর) যখন ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় তখন তার মন্তব্য ছিল “দুভিক্ষের জন্য তারাই দায়ী, কারণ এরা খরগোশের মত বাচ্চা দেয়”। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় আদিবাসী নিধনেরও সমর্থক ছিলেন তিনি। ৮ জুন তার মূর্তিতেও ভাংচুর করা হয়েছে। নিচে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘চার্চিল ইজ অ্যা রেসিস্ট ’ (চার্চিল একজন বর্ণবাদী)। মূর্তি অপসারণের দাবি জোরালো হওয়ায় প্রশাসন তা ঢেকে দিতে বাধ্য হয়েছে। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গোতে এক কোটিরও বেশি মানুষ হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। আন্টওয়ার্পে বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভের পর তার মূর্তিতে ভাংচুর করে দাসপ্রথার প্রতীক লাল রং মেখে দেওয়া হয়। গত ৯ জুন কর্তৃপক্ষ তার মূর্তি অপসারণ করে। গত ১২ জুন আদিবাসী মাউরিদের দাবির মুখে নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টন শহর থেকে বিতর্কিত বৃটিশ ক্যাপ্টেন জন চার্লস হ্যামিল্টন (শহরটির নাম তার নামেই) এর মূর্তি সরানো হয়। দাস ব্যবসায়ী, বর্ণবাদী, উপনিবেশবাদীদের মূর্তিগুলোর পর বর্ণবাদের আরেক নিদর্শন রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিরুদ্ধেও জনমানুষ সোচ্চার হয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে এসব ক্রিমের। রং ফর্সা ক্রিমের বিজ্ঞাপন করেও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন বলিউডের বেশ কজন প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাদের এরূপ দ্বিচারিতা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে বিদ্যমান ‘কালারিজম’ এর প্রতিও মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। এ অঞ্চলের বাদামী বর্ণের মানুষের মধ্যে তুলনামূলক কম বা বেশি ফর্সা হওয়ার ভিত্তিতে পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তির গুরুত্ব নির্ধারিত হয়। এর উপর ভিত্তি করেই টিকে আছে রং ফর্সাকারী ক্রিমের হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা। ক্রমেই এসব ক্রিম নিষিদ্ধ করার দাবি জোরালো হচ্ছে। গত ১৯ জুন বিখ্যাত জনসন এন্ড জনসন কোম্পানি ২টি রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। ২৫ জুন ইউনিলিভার রং ফর্সাকারী ব্রান্ড ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ এর নাম থেকে ‘ফেয়ার’ (ফর্সা) শব্দ বাদ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মোটকথা, জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর ‘ব্লাক লইভস ম্যাটার’ আন্দোলন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক বিপ্লবের সূচনা করেছে। পশ্চিমা সমাজ ও মানসে বিরাজমান এ বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্ববাদের (রেসিস্ট সুপ্রিমেসি) বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার সংগ্রামের রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। দীর্ঘ প্রতিবাদ আর আন্দোলনের পর ব্রিটেন দাসপথা বিলোপ আইন, ১৮৩৩ পাস করে। আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হয় দাসপ্রথা। তবে ব্রিটেনের চেয়ে আমেরিকার পথটা ছিল আরও সংগ্রামমুখর। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসপথা বিলোপ করতে গিয়ে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন। দক্ষিণী কনফেডারেটদের বিরোধিতা এক পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। চার বছরের (১৮৬১-১৮৬৫) সংঘাত শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দাসপথা বিলুপ্ত হয়। চতুর্দশ সংশোধনীর (১৮৬৮) মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গরা নাগরিকত্ব পায় এবং পঞ্চদশ সংশোধনী (১৮৭০) তাদেরকে ভোটাধিকার দেয়। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকানদের সামাজিক, নাগরিক ও রজনৈতিক অধিকার সুদূরপরাহত রয়ে যায়। সামাজিক এবং নাগরিক প্রতিষ্ঠান ও সুবিধার ক্ষেত্রে কালো মানুষদেরকে আগের মতই বিচ্ছিন্ন ও কোণঠাসা করে রাখা হয়। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট প্লেসি বনাম ফার্গুসন (১৮৯৬) মামলায় “সেপারেট বাট ইকুয়াল” (পৃথক হলেও সমান) নীতির ভিত্তিতে বৈষম্যকে আইনি বৈধতা দেয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগলো ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ গৃহিত হয়। ১৯৫৪ সালে ব্রাউন বনাম বোর্ড অব এডুকেশন মামলায় আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট সরকারি স্কুলে বিদ্যমান বর্ণভিত্তিক আলাদা আসন ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এই রায় কৃষ্ণাঙ্গদেরকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। তারা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, গণপরিবহন ও গণজমায়েত কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যমান বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯-১৯৬৮) এর নেতৃত্বেশুরু হয় ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’। ১৯৬৪ সালের ২ জুলাই ‘সিভিল রাইটস এক্ট’ পাস হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, গণপরিবহনে বর্ণবাদী বৈষম্য আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হয়। পরের বছর ‘ভোটিং রাইটস এক্ট, ১৯৬৫’ এর মাধ্যমে ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য মূলক আইনের অবসান অবসান ঘটে। আইনি বাঁধা দূর হলেও ব্যক্তি ও সমাজের মানসে ঠিকই বর্ণবাদ রয়ে যায়। যার প্রতিফলন দেখা যায় পুলিশি নৃশংসতা, রাজনীতি ও খেলার মাঠে নানা বর্ণবাদী ঘটনায়। বছর তিনেক আগেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু এমন বিপুল ক্ষমতা তাকে বর্ণবাদী আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থা কীরূপ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি নির্বাচিত দুই অশে^তাঙ্গ নারী কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর ও রাশিদা তালিব ক্রমাগত বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ক্ষমতাধর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের প্রতিও এমন বিদ্বেষমূলক আচরণ প্রমাণ করে যে শে^তাঙ্গরা এখনও কৃষ্ণাঙ্গদেরকে সমমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি। আর এ কারণেই ম্যালকম এক্স ওরফে আলহাজ¦ মালিক আল শাবাজ এর আন্দোলন ও তাঁর আহ্বানের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে ফিরে আসে। ১৯৫৮ সালে ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’ যখন তুঙ্গে, ম্যালকম এক্স (১৯২৫-১৯৬৫) তখন আমেরিকায় জাতীয় পরিচিতি লাভ করেন। তার পরিচয় এই আন্দোলনের নেতা হিসেবে নয়, বরং একজন কঠোর সমালোচক হিসেবে। ম্যালকম এক্স ও মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে দুই অবিসংবাদিত নেতা। তবে আমেরিকার বাইরের দুনিয়ায় ম্যালকম এক্স এর চেয়ে মার্টিন লুথার কিং বেশি পরিচিত। ম্যালকম এক্স এর পরিচয়ে এতটুকু বলা যথেষ্ট যে, বিশ^খ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের মতে বিংশ শতাব্দীর সেরা বিশটি ‘ননফিকশন’ বইয়ের একটি হলো ১৯৬৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত আত্মজীবনী। ২০১৫ সালে ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে ম্যালকম এর জন্মদিন ১৯ মে কে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ম্যালকম এক্স ও মার্টিন লুথার কিং দু’জনে ছিলেন কাছাকাছি বয়সের। দুজনের লক্ষ্য ছিল একটাই; কিন্তু পথ ছিল ভিন্ন। ফলে দুজনের মধ্যে কেবল একবারই সাক্ষাৎ হয়; ১৯৬৪ সালে ‘সিভিল রাইটস এ্যাক্ট’ পাসপূর্ব শুনানিতে। মার্টিন লুথার কিং ছিলেন অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে মার্কিন সমাজে ‘ইন্টেগ্রেশন’ এর পক্ষপাতী। বিপরীতে ম্যালকম এক্স এক যুগ ধরে বিপ্লবী, আত্মরক্ষারক্ষামূলক, কৃষ্ণাঙ্গ ঐক্য ও জাতীয়তার লক্ষ্যে সংগ্রাম করেছেন। ম্যালকম এক্স মনে করতেন, অহিংস আন্দোলন শুধু বিদ্যমান বর্ণবাদী বৈষম্যকে বৈধতাই দিবে। তাই তিনি শে^তাঙ্গ সহিংসতার মোকাবেলায় আত্মরক্ষারক্ষার কথা বলতেন। তবে সংক্ষিপ্ত অথচ ঘটনাবহুল জীবনের শেষ বর্ষে এসে তাঁর অন্যরকম বোধোদয় ঘটে। তিনি ঐক্য, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের মাঝে বর্ণবাদের সমাধান খুঁজে পান। ম্যালকম এক্স এর ৩৯ বছরের জীবন নানা বৈচিত্রময় ঘটনায় ভরপুর। তিনি ১৯২৫ সালে ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যে আর্ল লিটল নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারকর্মীর ঘরে জন্ম নেন। তিনি ছিলেন আট ভাইবোনের মাঝে চতুর্থ। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় ম্যালকম লিটল। মাত্র ৬ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি তার পিতাকে হারান। ম্যালকম ও তার পরিবারের বিশ^াস, তার পিতার মৃত্যুর পিছনে সন্ত্রাসবাদী শে^তাঙ্গ সংগঠন ‘কু ক্লাক্স ক্লান (কেকেকে)’ ও ‘ব্লাক লেজিওন’ এর হাত রয়েছে। পিতার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু ম্যালকমকে শে^তাঙ্গদের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ করে তুলে যা তার পরিণত বয়সের চিন্তা ও বিশ^াসকে প্রভাবিত করেছে। পিতার মৃত্যুর পর তার মা লুই লিটল অত্যন্ত দারিদ্র্যের মাঝে ম্যালকম ও তার ভাইবোনকে লালন পালন করেন। অসুস্থতার কারণে ১৯৩৯ সালে তার মা’কে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ম্যালকম ও তার ভাইবোনকে ‘ফোস্টার হোমে’ পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে স্কুলছাত্র হিসেবে ম্যালকম তীক্ষèমেধার পরিচয় দেন। ছোট ম্যালকম আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে তার শে^তাঙ্গ শিক্ষক তাকে আইনজীবীর বদলে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে কাঠমিস্ত্রি হতে বললে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে সেখানেই তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। স্কুল ছেড়ে তিনি মিশিগানে তার বৈমাত্রেয় বোন এলার কাছে চলে যান। সেখানে তিনি বখে যাওয়া তরুণ হিসেবে চোরাচালানি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা ও চুরি-ডাকাতির মত অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালে ছিনতাইয়ের অভিযোগে তার ৮ বছরের কারাদন্ড হয়। কারাগারে থাকাবস্থায় ১৯৪৮ সালে ভাই রেজিনাল্ডের পরামর্শে ‘নেশন অব ইসলাম’ নামের মুসলিম কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হন। নেশন অব ইসলাম হলো সুন্নী মুসালিমদের বাইরে ১৯৩০ সালে আমেরিকার মিশিগানে প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারকামী মুসলিমদের একটি সংগঠন যা ‘নেশন’ নামেই বেশি পরিচিত। তাদের বেশ কিছু বিশ^াস ইসলামী আকিদা-বিশ^াসের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যেমন: কৃষ্ণাঙ্গরা পৃথিবীর আদি মানুষ। তাই শে^তাঙ্গরা নয়; বরং কৃষ্ণাঙ্গরাই শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের আসল দাবিদার । তাদের মতে, ইসলামের সম্মানিত নবী ইয়াকুব (আ) ছিলেন একজন ‘শয়তান বিজ্ঞানী’ যিনি প্রথম শে^তাঙ্গদের সৃষ্টি করেন। অথচ ইসলাম বলেছে, সব কিছুর স্রষ্টা কেবল আল্লাহ তা’আলা। তাদের ধারণা, অচিরেই ‘শয়তানের বংশধর’ এই শে^তাঙ্গদের বিলুপ্তি ঘটবে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালেস ফার্দ মুহাম¥দকে ‘ইমাম মাহদি’ বলে মনে করে। এ সব কিছুই ইসলামের আকিদা বিশ্বাসের বিরোধী। তথাপি নেশনের প্রভাবে ম্যালকম এক্স ব্যক্তিজীবনে ধূমপান, মদ্যপান, জুয়া, শূকরের গোশত খাওয়া ত্যাগ করেন। তিনি কারা পাঠাগারে অধ্যয়নে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে শুরু করেন এবং কারাভ্যন্তরে বিতর্কে অংশ নিয়ে তুখোড় বক্তৃতাগুণ প্রদর্শন করেন। নেশনের ভাবাদর্শ ও নীতির প্রতি তার আগ্রহের কথা জানিয়ে এর তৎকালীন প্রধান এলিজাহ মুহাম্মদের (১৯৩৪-১৯৭৫) কাছে চিঠিও লিখেন। এ সময় তিনি শে^তাঙ্গ দাস মালিকের দেয়া বংশীয় পদবী ‘লিটল’ পরিবর্তন করে নিজের নাম রাখেন ‘ম্যালকম এক্স’। ইংরেজি ‘এক্স’ প্রতীকীভাবে তার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত হওয়াকে নির্দেশ করে। ১৯৫২ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ‘নেশন’ এর কার্যক্রমে যোগ দেন এবং শিকাগোতে গিয়ে এলিজাহ মুহাম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সুদর্শন ও দীর্ঘদেহী ম্যালকম এক্স তার ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব, বাগ্মীতা ও অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই এলিজাহ মুহাম্মদের প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। তিনি বোস্টন, আটলান্টা, ডেট্রয়েট সহ বিভিন্ন শহরে নেশন এর মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ম্যালকম এক্স দ্রুতই নিউ ইয়র্কের হার্লেমে অবস্থিত নেশন এর দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ এর ‘মিনিস্টার’ (প্রধান) নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে এলিজাহ মুহাম্মদ তাঁকে ‘নেশন’ এর জাতীয় মুখপাত্র নিযুক্ত করেন। ম্যালকম এক্স এর প্রভাবে নেশন এর সদস্য সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ধারণা করা হয়, তাঁর প্রভাবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ নেশন এর সদস্য হয়। তিনি ১৯৫৭ সালে ‘নেশন’ এর মুখপাত্র পত্রিকা ‘মুসলিম স্পিকস’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর বিখ্যাত ‘হিলটন জনসন ঘটনা’র পর তাঁর নাম পুরো আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় তার জনপ্রিয়তা এলিজাহ মুহাম্মদকেও ছাড়িয়ে যায়। তিনি নেশন এর জাতীয় আইকনে পরিণত হন। ১৯৫৯ সালে নেশনের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। এ সময় তিনি নিজের নাম ম্যালকম এক্স এ পরিবর্তে ‘মালিক আল শাবাজ’ লেখা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ম্যালকম বিশ^বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ বক্সার মুহাম্মদ আলীকে ‘নেশন’ এর সদস্য হতে সাহায্য করেন এবং তার আধ্যাত্মিক গুরুতে পরিণত হন। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি তুখোড় বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড এর মত বিশ^বিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। ম্যালকম এক্স তার বক্তৃতায় মূলধারার ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’ কে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতেন। এর পরিবর্তে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন। অহিংস নীতির বদলে তিনি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আত্মরক্ষার কথা বলতেন। ম্যালকম এক্স আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গী, প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ, বিদ্রুপ ও বিদগ্ধ রসের মিশ্রণ দিয়ে “ব্লাক ইজ বিউটিফুল” “ব্লাক প্রাইড” এর মত স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তুলেন। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হওয়াকে একটি গর্বের বিষয়ে পরিণত করেন। বলা যায়, তাঁর একক প্রচেষ্টাতেই আফ্রিকান-আমেরিকানরা ‘নিগ্রো’র বদলে কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো বলে অভিহিত হতে শুরু করে। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে আফ্রিকান দেশগুলোর আমন্ত্রনে বিশেষ অতিথি হিসেবে জাতিসংঘের অধিবেশনেও বক্তব্য রাখেন। ১৯৬৩ সালে নেশন ও ম্যালকম এক্স জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাবস্থায় এলিজাহ মুহাম্মদ এর সাথে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। ম্যালকম এক্স কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আদয়ে প্রতিবাদ ও মোকাবেলায় নেশন কে আরো সক্রিয় করতে চাইছিলেন। কিন্তু এলিজাহ এতে বাধ সাধেন। কিছুদিন পর একাধিক নারীর সাথে এলিজাহ এর অনৈতিক সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে পড়লে ম্যালকম তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হওয়ার পর এক বিতর্কিত মন্তব্যের অজুহাতে ম্যালকম এক্স কে ৯০ দিনের জন্য বক্তৃতা থেকে নিষিদ্ধ করে নেশন। ম্যালকম এতে দারুণভাবে আহত হন। ১৯৬৪ সালের ৮ মার্চ প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে নেশন ত্যাগ করেন। সম্পর্কচ্ছেদের পর এলিজাহ ম্যালকম এক্স এর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক বক্তব্য দিতে থাকেন। এমনকি একাধিকবার তাঁকে মৃত্যুর হুমকিও দেয়া হয়। নেশন থেকে আলাদা হওয়ার সাথে সাথে ম্যালকম এক্স তাদের আদর্শ-বিশ^াস থেকেও সরে আসেন। শে^তাঙ্গ বিদ্বেষ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও আফ্রিকায় ফিরে যেত বলার পরিবর্তেসার্বজনীন কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বর্ণবাদের সমস্যাকে একজন সমাজবিজ্ঞানীর চোখে দেখতে শুরু করেন। এসময় ‘মুসলিম মসজিদ ইনক.” নামে একটি নতুন সংগঠনও গড়ে তুলেন। হজে¦র মওসুম এলে ম্যালকম এক্স হজ¦ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেখানে তিনি এক নতুন জগতের সন্ধান পেলেন যা তার এতদিনের ধর্ম, বিশ^াস, চিন্তা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল পাল্টে দিল। তিনি অনুধাবন করলেন, তার এক যুগের সংগ্রামকে সাফল্যের দুয়ারে ভিড়াতে পারে কেবল ইসলামের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ। হজ¦ পালন শেষে ম্যালকম এক্স আরব বিশ^ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তার আগে মক্কায় বসেই তাঁর অভিজ্ঞতা ও হৃদয়ের উপলব্ধি ব্যক্ত করে আমেরিকায় পরিবার ও সহকর্মীদের কাছে কয়েকটি চিঠি লেখেন। সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর জীবনবোধে পূর্ণ এসব চিঠি আমেরিকায় সাড়া ফেলে দেয়। তাঁর চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে ৮ মে ১৯৬৪ নিউ ইয়র্ক টাইমস “ম্যালকম প্লিজড বাই হোয়ইট’স এটিটিউড অন ট্রিপ টু মক্কা” (মক্কায় গিয়ে শে^তাঙ্গদের আচরণে মুগ্ধ ম্যালকম) শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কী ছিল সেই চিঠিতে? আলহাজ মালিক আল শাবাজ নামে ম্যালকম এক্স লিখেন, জেদ্দায় এসে তিনি তৎকলীন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ (পরবর্তীতে বাদশাহ ফয়সাল) এর রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ইবরাহিম (আ), মুহাম্মদ (স) এর স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ভূমিতে এসে তিনি অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও আন্তরিকতায় সিক্ত হন। চারপাশের নানা বর্ণের মানুষের উদারতা ও বদান্যতা তাকে বাকরুদ্ধ ও হতবাক করে দেয়। তিনি সঙ্গীয় মুসলিমদের সাথে একই আল্লাহর ইবাদত করেছেন, এক প্লেটে খেয়েছেন, এক গ্লাসে পান করেছেন এবং এক বিছানায় ঘুমিয়েছেন; যাদের ছিল সবচেয়ে নীল চোখ, সবচেয়ে সোনালী চুল ও সর্বাধিক সাদা ত্বক। সেসকল শে^তাঙ্গ মুসলিমের কথা ও আচরণে তিনি নাইজেরিয়া বা সুদানের আফ্রিকান মুসলিমের মতই আন্তরিকতা অনুভব করেছেনে। কারণ মুসলিমরা আল্লাহর এককত্বের পাশাপাশি মানব পরিবারের এক হওয়াতেও বিশ^াস করে। তাই মুসলিম হওয়ার সাথে সাথে একজন মানুষ আর সাদা বা কালো থাকে না। একজন মুসলিমের যোগ্যতা ও গুরুত্ব বিচারে তার বর্ণের কোনো মূল্য থাকে না। তাঁর ভাষায় “আমরা ছিলাম প্রকৃতই ভাই ভাই- কেননা এক আল্লাহর প্রতি বিশ^াস তাদের মন, মানস ও আচরণ থেকে শে^ত মনোভাব কে মুছে দিয়েছে।” তিনি কল্পনা করতে পারছিলেন না এমন অনেক ব্যক্তি তাঁর জন্য নিজের হোটেল রুম এমনকি বিছানা ছেড়ে দিবেন, যাদেরকে আমেরিকায় হয়ত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন শে^তাঙ্গ বলে অভিহিত করা হবে। তিনি কখনো এতটা সম¥ানিত বোধ করেননি। তাঁর প্রতি প্রদর্শিত এমন সম্মান আমেরিকায় কেবল একজন রাজাই পেতে পারেন, কোনো ‘নিগ্রো’ নয়। তিনি বুঝতে পারেন, যদি শে^তাঙ্গ আমেরিকানরা ইসলামকে ধর্ম হিসেবে প্রহণ করত, আল্লাহর একত্ববাদকে মেনে নিত; তাহলে তারা সাদা-কালো ভুলে মানব জাতির এককত্বের বাস্তবতাও মেনে নিতে পারত। নিছক বর্ণের ভিন্নতার কারণে কাউকে কষ্টও দিত না। নীল চোখের স্বর্ণকেশী থেকে কালো চামড়ার আফ্রিকান; সকল বর্ণের লাখো হাজী সারা বিশ^ থেকে এসে মক্কায় জড়ো হয়েছেন। সকল জাতি-বর্ণের মানুষ মিলে হজে¦র বিধানাবলী (তথা কাবা তওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় সায়ী, মীনা-আরাফায় অবস্থান ইত্যাদি) পালন যেন তাদের অকৃত্রিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনার প্রদর্শনী। সত্যিকার ভ্রাতৃত্ববোধের এ এক বিস¥য়কর চেতনা। সাদা-কালোর ভেদাভেদ তাদেরকে পৃথক করার পরিবর্তে তাদের মধ্যকার বৈচিত্রকে ফুটিয়ে তুলছে। এটা এমন এক ব্যাপার যা আমেরিকায় অকল্পনীয়। এরকম অনেক দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা ম্যালকম এক্স এর পূর্বতন চিন্তা ও দর্শনকে পাল্টে দেয়। তিনি সম্পূর্ণরূপে নেশন অব ইসলাম এর মতাদর্শ ছেড়ে চিরায়ত ইসলামী (সুন্নী) আদর্শকে গ্রহণ করেন। ম্যালকম এক্স তাঁর চিঠিতে আমেরিকান সমাজের করণীয়ও বাতলে দেন। তাঁর মতে, “আমেরিকার ইসলাম বুঝা দরকার। কেননা এটা এমন এক ধর্ম যা সমাজ থেকে বর্ণের সমস্যা মুছে ফেলে।” ইসলাম যেভাবে মুসলিম বিশে^র মানস থেকে শে^ত মনোভাব ঘুচিয়ে দিয়েছে, একইভাবে তা সত্যিকার ভ্রাতৃত্ববোধ দিয়ে আমেরিকান মানসকেও পাল্টে দিতে পারে। তাই “বর্ণবাদ যখন আমেরিকাকে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, তখন ‘খ্রিস্টান’ শে^ত আমেরিকান হৃদয়ের উচিত ধ্বংসাত্মক সমস্যার এই প্রমাণিত সমাধানের প্রতি অধিকতর আগ্রহী হওয়া।” হয়ত এটা আমেরিকাকে সেরকম আসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে; যেরকমভাবে জার্মানির বর্ণবাদ জার্মানদেরকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। ম্যালকম এক্স আশংকা করেন, “বর্ণবাদী উন্মত্ততা আমেরিকাকে এক আত্মঘাতী পথে নামিয়ে দিয়েছে।” তবে তাঁর বিশ^াস, “আমেরিকাকে এ অনিবার্য বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে কলেজ-ভার্সিটির তরুণ প্রজন্মের শে^তাঙ্গদের অনেকেই পরিত্রানের একমাত্র উপায় হিসেবে সত্যের এই আধ্যাত্মিক পথেই ফিরে যাবে।” হজ¦ থেকে ফিরে ম্যালকম এক্স ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের আলোকে তার সংগ্রাম নতুনভাবে শুরু করেন। ইসলামের এই প্রকৃত ভ্রাতৃত্ববোধের প্রচার নেশনকে শংকিত করে তুলে। তাদের শে^তাঙ্গ বিদ্বেষী বিচ্ছিন্নতাবাদী আদর্শ হুমকির মুখে পড়ে যায়। তারা ক্রমাগত ম্যালকম এক্স কে হত্যার হুমকি দিতে থাকে। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী নেশনের পাঠানো আততায়ীর গুলিতে শহীদ হন ম্যালকম এক্স। জীবন দিয়েই ম্যালকম এক্স তাঁর বিশ^াসের মূল্য দিয়ে গেলেন। ম্যালকম এক্স এর মৃত্যুর পর ৫৫ বছর গত হয়েছে। কিন্তু বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে তাঁর আহ্বান আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম মৃত্যু সেটা আরও একবার আমেরিকানদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল।
মোহাম্মদ শিশির মনির এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সঙ্গে মোনায়েম খান শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ^াবদ্যালয়।