স্টাফ রিপোর্টার ::
বজ্রপাতের কারণে হাওর দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে। খোলা বিস্তৃত হাওরে সহজেই বজ্রপাতে হতাহত হচ্ছেন হাওরের মানুষ। বিশ্ব জরিপে এর আগেই সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলকে বিশ্বের বজ্রপাত প্রবণ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। হাওরে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। গত ১০ দিনের ব্যবধানে জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলায় পুত্রসহ তিন পিতা বজ্রপাতে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছেন। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার সকালে জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনার হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হন ফেনারবাঁক ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের ভানু মিয়া (৩৬) ও তার ছেলে সুমন মিয়া (১৩)।
এছাড়াও একই উপজেলায় গত ১০ জুলাই জামালগঞ্জে স্কুল থেকে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বজ্রপাতে সাবিদুর রহমান (৪৫) ও তার ছেলে অন্তর (৬) মারা যান। ১৩ জুলাই তাহিরপুর উপজেলার হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হন হারিদুল ইসলাম (৫০) ও তাঁর ছেলে তারা (১৩)।
আবহাওয়া অফিস বলছে, দেশের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা সুনামগঞ্জ। গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনসহ এ অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানকেও দায়ী করছেন আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। সরকারিভাবে তালগাছ রোপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দীর্ঘ মেয়াদী এই প্রকল্পের সুফল পেতে কয়েক যুগ লাগবে বলে মনে করেন স্থানীয় অভিজ্ঞজন। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণে হাওরে তালগাছ লাগালেও বেচে থাকার সম্ভাবনাও কম বলে তারা জানিয়েছেন। এ কারণে স্থানীয় অভিজ্ঞজন বহনযোগ্য বজ্রনিরোধক দ- নিরুপণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
আবহাওয়াবিদ মো. মোমেনুল ইসলাম বলেন, ২০১০ সালের পর দেশে বজ্রপাত বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০১৬ সালে পর পর দুদিনে বজ্রপাতে ৮১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরপরই বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়। তিনি জানান, প্রতিবছরে বিশ্বের বায়ুম-লে ২ কোটি বার বজ্রপাত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সালে গিয়ে বজ্রপাতের সংখ্যা দাঁড়াবে তিন কোটিতে। এ অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতিও বাড়বে স্বাভাবিকভাবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মশিউর রহমান জানান, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মূলত বজ্রপাত বাড়ছে। পৃথিবীর বায়ুম-ল দ্রুত গরম হয়ে যাওয়ায় মেঘ তৈরির স্বাভাবিক পরিবেশ থাকছে না। আর দ্রুত মেঘ তৈরির সময়ে বাড়ছে বজ্রপাত।
মশিউর রহমান জানান, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বায়ুম-ল দ্রুত গরম হয়ে যায়। তখন সিভি ক্লাউড বা বজ্রমেঘের পরিমাণও বাড়ে। জলীয় বা®পগুলোকে নিয়ে ভূমির গরম বাতাস যখন তীব্র বেগে ওপরে ওঠে তখন দ্রুত এই বা®প শীতল হয়ে যায়। এই শীতল পানির কণাগুলো এরপর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে নিচে নামতে থাকে। কিন্তু নিচে থেকে গরম বাতাসের চাপে এগুলো আবার গলে বা®প হয়ে ওপরে ওঠে। এভাবে কয়েকবার এই বা®পকণাগুলো ওঠানামা করতে করতে এগুলো বৈদ্যুতিক আয়ন কণায় পরিণত হয়। আর এই কণাগুলোই বিপুল শক্তির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। তবে আয়ন কণায় পরিণত হওয়ার পর এগুলো স্বাভাবিকভাবেই মেঘের ওপর ভাসে। কিন্তু যখন ভূপৃষ্ঠের আয়ন ধারণের ক্ষমতার কারণে এগুলো আবার মাটির দিকে চলে আসে। আর এই আয়ন কণাগুলো মেঘের ভেতর দিয়ে বজ্রের আকারে নিচে নেমে আসে।
এই গবেষকের আশঙ্কা অদূর ভবিষ্যতে বজ্রপাত বাড়বে বই কমবে না। কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, সারাবিশ্বেই উষ্ণায়ন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বৃদ্ধি পায়। এ হিসাবে বজ্রপাত প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গবেষকদের মতে ২০৫০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে বজ্রপাতের ঝুঁকিও সমান হারে বাড়বে। এছাড়া বজ্রপাতের কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকেও দায়ী করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, ভূপৃষ্ঠ থেকে বাতাসে যত কার্বন যাবে, বজ্রপাতের সংখ্যা তত বাড়বে।
মশিউর রহমান আরো জানান, আগে সারাদেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তাল-খেজুরের মতো লম্বা গাছের প্রাচুর্য ছিল। আর এই দীর্ঘকায় গাছগুলো বজ্রপাত প্রতিরোধ করতো। গাছগুলো কমে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এই আবহাওয়াবিদ।
বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর মূল কারণ সচেতনতার অভাব বলে উল্লেখ করেন আবহাওয়াবিদরা।
মশিউর রহমান জানালেন, প্রাকৃতিক যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছুদিন আগেও মানুষ এই দুর্যোগকে ঠেকাতো সেগুলো এখন আর নেই। গাছ তো নেইই। বাড়িঘরের ওপরে প্রথাগত যে লোহার সংকেতের মাধ্যমে বজ্রপাত প্রতিরোধের যে ব্যবস্থাপনা ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এই কারণেই এখন মানুষ মারা যাচ্ছে।
মশিউর রহমান আরো বলেন, সাধারণত ১০০ থেকে ১১০ ভোল্ট বিদ্যুৎ কোনো মানুষের ভেতরে প্রবাহিত হলে ওই ব্যক্তির মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু বজ্রপাতের সময় একজনের শরীরে ৫৫০ থেকে ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ফলে ওই দেহ পুড়ে যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের এই গবেষক আরো জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাত অন্যতম ভয়ঙ্কর ও প্রাণসংহারী। কারণ এই দুর্যোগের আগাম সংকেত দেওয়ার কৌশল এখনও উদ্ভাবন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ফলে এটি থেকে বাঁচতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেছেন মশিউর রহমান।
আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বজ্রপাত প্রতিরোধে সচেতনতা ও গবেষণা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, বিশ্বে বজ্রপাতে নিহতের এক চতুর্থাংশ বাংলাদেশেই হয়। শুধু মানুষই নয়, মারা যাচ্ছে গৃহপালিত প্রাণীও। ফলে বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে। কেন বজ্রপাত বাড়ছে, এটি প্রতিরোধে কী কী করা যেতে পারে, কীভাবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো যায় তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাইদুর রহমান বলেন, হাওর বিস্তৃত খোলা অঞ্চল। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই অন্য এলাকার চেয়ে হাওর বজ্রপাত ঝূকিপূর্ণ। যার ফলে প্রতিনিয়তই মৃত্যু বাড়ছে।
পরিবেশকর্মীরা মনে করেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি রোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা বাড়ানো। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। সেই সাথে বজ্র নিরোধন ব্যবস্থা তৃণমূলে পৌঁছে দেয়ারও দাবি তাদের। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে আবহাওয়া খারাপ দেখলে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া খোলা স্থানে না থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
দৈনিক দিরাই শাল্লা
৭:৪৩ অপরাহ্ণ