এমসিতে গণধর্ষণের ঘটনা : আ.লীগ নেতার ‘সমঝোতার চেষ্টা’

 

ডিএনএ পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট প্রস্তুত…..

‘সমঝোতার প্রস্তাবকারী ব্যক্তি সাইফুরের এলাকার চেয়ারম্যান’…..

পুলিশের কার্যক্রমে এখনো সন্তুষ্ট বাদী
শিগগির চার্জশিট দাখিল…….

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
চলতি বছরের ২৫ সে সেপ্টেম্বর রাত ছিলো সিলেটবাসীর জন্য একটি জঘন্যতম রাত। সেদিন সন্ধ্যায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করেন কয়েকজন যুবক। পরে জানা যায় তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। এ ঘটনার দুই মাস পূর্ণ হবার পথে।

এমন যখন অবস্থা তখন অনেকটাই ভুলতে বসেছে মানুষ। কিন্তু মানুষ নীরব হওয়ার সাথে সাথে পাওয়া গেল আজব এক তথ্য। জানা গেছে- ‘এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এ মামলার প্রধান আসামি সাইফুরের হয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন।’

ভুক্তভোগী তরুণীর স্বামী সিলেট ভয়েসকে জানান, ‘সাইফুরের এলাকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনহার মিয়া সমঝোতার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। উনি আমার চাচা শ্বশুরের সাথে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু আমার চাচা শ্বশুর বলেছেন এটা তার স্বামী বুঝবে। যেহেতু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আমি কিছু বলতে পারব না।’

পরবর্তীতে চেয়ারম্যান আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না আমার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি।’

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিকটিম ওই তরুণীর স্বামী সমঝোতার প্রস্তাবকারী হিসেবে যার নাম বলেছেন তিনি হলেন- বালাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বালাগঞ্জ উপজেলার বোয়ালজুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনহার মিয়া। তাঁর বাড়ি গণধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমানের একই এলাকায়। সে হিসেবে সাইফুর চেয়ারম্যান আনহার মিয়ার প্রতিবেশী।

তবে যে ঘটনায় নাড়িয়ে দিয়েছিলো মানুষের বিবেক। অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে যেখানে মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে সেখানে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়াকে সংবিধান বহির্ভূত বলে মন্তব্য করলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী।

তিনি সিলেট ভয়েসকে বলেন, ‘যদি এমন ঘটনা সত্য হয়ে থাকে তাহলে উনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। কারণ, দেশের প্রচলিত আইনে যেখানে বিচার চলছে সেখানে উনি সমঝোতার প্রস্তাব দিলে এটা সংবিধানবিরোধী। তাই আমি মনে করি এসব মানুষকেও শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ।’

আর একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে এমন প্রস্তাব দিয়ে থাকলে সেটি নিন্দনীয় ও জঘন্য বলে মন্তব্য করলেন সম্প্রতি ধর্ষণ প্রতিরোধে গঠিত সিলেটের নাগরিক প্লাটফর্ম ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’ এর সংগঠক আব্দুল করিম কিম। তিনি বলেন, ‘যদি সত্যি এমন প্রস্তাব উনি দিয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই এটি নিন্দনীয়। কারণ সিলেটসহ সারা দেশের মানুষ যেখানে এর বিচার চাইছেন সেখানে রাজনৈতিক দলের একজন নেতা ও জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে এমন প্রস্তাব আশা করা যায় না। তাছাড়া যে ঘটনায় পুরো সিলেটের ঐতিহ্যে নষ্ট করেছে সেখানে উনার এমন প্রস্তাবে আমরা মর্মাহত।’

তবে সমঝোতার প্রস্তাবের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বোয়ালজুড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনহার মিয়া। সিলেট ভয়েসের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সাইফুর আমার প্রতিবেশী। কিন্তু সমঝোতার কোন প্রস্তাব আমি কাউকে দেইনি। এমনকি মেয়ের কারো সাথে আমার কোন যোগাযোগ হয়নি।’

এদিকে গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার সকল আসামির ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট প্রস্তুত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন- সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের।

তিনি বলেন, ডিএনএ পরীক্ষা শেষ। রিপোর্ট কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে। রিপোর্ট আসার পর আনুষ্ঠানিক আরো কিছু কাজ শেষ করেই চার্জশিট দিবেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

এছাড়াও গণধর্ষণের ঘটনার পরপর সাইফুরের কক্ষে অভিযান করে অস্ত্র উদ্ধার মামলারও তদন্ত শেষ পর্যায় বলেও জানান অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আরাফ উল্যাহ তাহের।

অবশ্য পুলিশের কার্যক্রমে এখনো সন্তুষ্ট মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী তরুণীর স্বামী। তিনি সিলেট ভয়েসকে বলেন, এখনো পুলিশের কাজে আমি সন্তুষ্ট। মাঝে মাঝে শাহপরাণ থানার তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে ফোন দেন। খোঁজখবর নেন।

ধর্ষীতা তরুণী বর্তমানে কেমন আছেন, তার মানসিক অবস্থা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সুস্থ আছেন৷ মানসিক অবস্থাও অনেকটা ভালো।

কোন পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ বা ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না কেউ কোন চাপ দিচ্ছে না। কেউ কোন ভয়ও দেখাচ্ছে না। কেবল আনহার চেয়ারম্যানই সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন আমার চাচা শ্বশুরের কাছে।’

অপরদিকে গণধর্ষণের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ইতোমধ্যে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মহি উদ্দিন শামিম গঠিত বেঞ্চে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হলরুমে গত ৪ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ ঘটনায় গণশুনানি হয়। পরে কমিটির সদস্যরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের গণধর্ষণের ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সাক্ষীদের জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করে গত ১৬ অক্টোবর ১৭৬ পৃষ্টার একটি তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্ট বেঞ্চে জমা দেওয়া হয়েছে। যার শুনানি হয় ২০ অক্টোবর। এদিন শোনানি শেষে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।

এদিকে গণধর্ষণের এ ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে ২৬ অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দোহাই দিয়ে কলেজ কমিটির এ প্রতিবেদনটি সিলগালা করে রাখেন।

তাছাড়া গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত চার আসামির ছাত্রত্ব এবং সার্টিফিকেট বাতিল করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন, সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান।

এর আগে ঘটনার কয়েকদিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গণধর্ষণের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি এমসি কলেজে তদন্ত করতে আসে। তদন্ত শেষে তারা তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিগত ২৫ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) রাত সাড়ে ৭ টার দিকে সিলেট এমসি কলেজের হোস্টেলে ওই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। অভিযুক্ত এসব কর্মীরা সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের অনুসারী বলে জানা গেছে।

এ ঘটনায় ৬ জনকে আসামি করে এসএমপির শাহপরাণ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। নির্যাতিত ওই তরুণীর স্বামী মাইদুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।

মামলায় আসামিরা হলেন- সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার উমেদনগরের রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), হবিগঞ্জ সদরের বাগুনীপাড়ার মো. জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), জকিগঞ্জের আটগ্রামের কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৫), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুর (জগদল) গ্রামের রবিউল ইসলাম (২৫) ও কানাইঘাটের গাছবাড়ি গ্রামের মাহফুজুর রহমান মাসুমকে (২৫)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও তিনজনকে আসামি করা হয়।

মামলার প্রেক্ষিতে র‍্যাব ও জেলা পুলিশের অভিযানে আটক ৮ জন কারাগারে আছে। গ্রেপ্তার সকলকেই ৫ দিন করে রিমান্ডে পায় পুলিশ। রিমান্ড শেষে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হলে তারা সকলেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন।

সুত্র-সিলেট ভয়েস ডটকম।