হাওর রক্ষা বাঁধ- নীতিমালায় কৃষক, বাস্তবে সিন্ডিকেট

হাওর-বাওর এলাকা সুনামগঞ্জ। সারা দেশে হাওরকন্যা হিসেবে আখ্যায়িত পেয়েছে এ জেলা। প্রান্তিক জনগোষ্টি থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে ২০১৭ সালের অকাল বন্যা কৃষকদের মাঝে ভয় সঞ্চারিত হয়। চৈত্র মাসের বন্যায় হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর সরকার কৃষকদের পাশে দাঁড়ান। ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে এদেশের কৃষক বাঁচিয়ে রাখেন। সরকারের এই উদ্যোগে ২০১৭ সালের ভয়কে জয় করেই ঘুরে দাঁড়ান হাওরপাড়ের কৃষকেরা। এরপর থেকেই বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওরপাড়ের কৃষকদের ফসল রক্ষার্থে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছেন হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে।
অতীতেও সরকার হাওর রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। প্রায় এক দশক আগে সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে হাওর এলাকায় পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন প্রকল্প ছিল। সেইসঙ্গে এলাকার সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলা হয়। এছাড়াও নদী অববাহিকায় পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও খাল খননের মাধ্যমে নাব্যতা সচল এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পরিকল্পনাও নেয়া হয়। এরপরও হাওর অঞ্চলে ফসলহানিসহ নানা বিপর্যয়ের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ফসলডুবির ঘটনা নতুন নয়। দু’তিন বছর পরপরই ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে অকাল বন্যার পানি হাওরে ঢুকে পড়ছে। কৃষককে পথে বসিয়ে ‘ধানের খনি’ জলের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে।
এক ফসলি এলাকা হওয়ায় ফসলডুবির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখানকার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। তবে ২০১৭ সালের আগে বাঁধ নির্মাণের কাজ ঠিকাদারের মাধ্যমে করা হত। ঠিকাদারদের লুটপাটের ফলে ঘটে যায় হাওরে মহাপ্লাবন। এরপর থেকেই হাওরের বাঁধ সুষ্টুভাবে নির্মাণের জন্য সরকার নতুন নীতিমালা প্রনয়ণ করেন। এই নীতিমালায় জেলা প্রশাসক, পওর বিভিাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারি প্রকৌশলীকে দায়িত্বভার দেয়া হয়। ওদের মাধ্যমে হাওর এলাকায় কৃষক প্রতিনিধিদের দিয়ে বাঁধ নির্মাণে পিআইসি(প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করার কথা উল্লেখ করা হয়। সরকার যেখানে নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে নীতিমালার কোনো তোয়াক্কা করছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সুনামগঞ্জ জেলার বেশির ভাগ উপজেলায় হাওর রক্ষা বাঁধ কৃষকদের আতংকিত করে তুলছেন। এর মধ্যে শাল্লা উপজেলা অন্যতম। এই উপজেলায় প্রতি বছরই পিআইসি গঠন করা হয় জমিহীন ব্যক্তিদের দিয়ে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নেয়া হয় সকল প্রকল্পের কাজ। কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই পিআইসি অনুমোদন দিচ্ছে উপজেলা কাবিটা স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটি। শুধু তাই নয়, যে এলাকায় বাঁধ সেই এলাকার কোনো কৃষককে পিআইসিতে রাখা হচ্ছে না। অন্য এলাকার লোক দিয়ে পিআইসি গঠন করে বাঁধ নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। সরকারের নীতিমালায় পিআইসিতে কৃষক অর্ন্তভুক্ত করার কথা থাকলেও এসব নীতিমালা মানছেন না সংশ্লিষ্টরা। ফলে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে পিআইসি গঠনে নীতিমালা চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মনে করছেন কৃষকরা।
কৃষকের মূখে মূখে অভিযোগ উঠছে পিআইসি গঠন করে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। আর এই চক্রের লোকেদের দিয়ে পিআইসি গঠন করে প্রকৃত কৃষকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণ সুষ্টুভাবে সম্পন্ন করা সরকারের বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ। এই উদ্যোগকে ধুলিসাৎ করার জন্য সিন্ডিকেট চক্রের লোকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সরকারের কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ আত্মসাৎ করার জন্য হাওর এলাকায় পিআইসি গঠন দৃশ্যপট হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিআইসি গঠনে প্রতিটি বাঁধ-প্রকল্পে একের অধিক আবেদন করা হয়েছে। দেখা গেছে প্রকৃত কৃষকদের আবেদন বাতিল করে সিন্ডিকেট বলয়ের অসাধু লোকদের আবেদন গ্রহণ করে উপজেলা কাবিটা স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায় কমিটি কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
হাওরপাড়ের শাল্লায় এখন পিআইসি গঠন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠছে। উপজেলা কাবিটা স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির এমন দৃশ্যপটে মুখ খুলেছেন শাল্লা উপজেলা ভেড়াডহর হাওরের কৃষক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস ছাত্তার মিয়া। তিনি পিআইস গঠন তালিকার বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছেন। এমনকি উপজেলার প্রতিটি পিআইসি যাচাই-বাছাই করে পুন:প্রনয়ন করার দাবী জানিয়েছেন তিনি।
হাওরপাড়ের কৃষকদের ভাগ্যের হাতিয়ার হচ্ছে ফসলরক্ষা বাঁধ। আর এই বাঁধকে নিয়ে প্রতিবছরই ছিনিমিনি খেলা হয়। প্রকৃত কৃষকদের মাধ্যমে পিআইসি গঠন করা হলে লুটপাটের রাজ্য থেকে সিন্ডিকেট চক্রটি বিতাড়িত হবে। তাই লুটপাট কায়েম করার সুবিধার্থে সিন্ডিকেট চক্রটি উপজেলা কাবিটা স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটিকে ঘিরে ফেলেছে।
এই ফসলরক্ষা বাঁধ নিয়ে চোর পুলিশের খেলা না খেলার জন্য হাওরের প্রতিটি কৃষকেরা দাবী জানিয়েছেন। তাই হাওর পাড়ের কৃষকদের দাবী সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত কৃষকদের মাধ্যমে পিআইসি গঠন করে বাঁধ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরী।
লেখক

বিপ্লব রায়
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
শাল্লা।