উবাইদুল হক——
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে হাওরের পানি কমার সাথে সাথে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে একদল রাখাল গরু নিয়ে মাঠে ছুটছে। নিত্যচলে গরু চরানো। সকাল থেকে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত গরুর পাল নিয়ে মাঠেই সময় পার করে থাকেন তারা। যদিও রাখালের হাতে বাঁশি নেই। বাতাসে ভেসে আসছেনা সুরের ঢেউ। তবুও দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আছে। আছে গরুর পাল ও রাখাল এই অঞ্চলের অনেক এলাকায় এখনো রাখাল প্রথা চালু রয়েছে। উপজেলার পথে প্রান্তরে রাখাল গরুর পাল নিয়ে মাঠে মাঠে ঘাস খাওয়াচ্ছে। তবে গৃহস্থের চুক্তিভিত্তিক রাখাল হিসেবে নয়।পালা করে একেক জন রাখাল কয়েক গৃহস্থ পরিবারের ১০০/২০০টি গরু নিয়ে মাঠে চরাচ্ছেন। আর রাখাল নামের আড়ালে হারিয়ে গেছে ওদের আসল নাম। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে একশ্রেণির শিশু মা-বাবার ইচ্ছায় রাখাল হয়ে বেড়ায় মাঠে ময়দানে। সকালে গরু নিয়ে চলে যায় মাঠে ময়দানে। সারাদিন গরু চড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে তারা। দুপুরে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া বাটির খাবার খায় ওরা। দিনভর গরু খোলা মাঠে ঘাস খায়। আর রাখালেরা গরু পাহারা দেয়। এসব কাজ রাখাল রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে করে। বজ্রপাতে মাঠে ওই শিশুদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সরজমিন দেখা যায়, গ্রাম এলাকায় কয়েক ঘরের গরু একজনে নিয়ে মাঠে বা হাওরে যায়।
উপজেলার কালিয়াকোটা হাওরে দেখা মেলে হাম্মাদ মিয়া নামের ১১ বছরের এক শিশুর সাথে, সে রফিনগর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের হাইয়ুম মিয়ার ছেলে,যে বয়সে তাকে বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা বন্ধুদের সাথে খেলার মাঠে হৈ হুল্লুর করার কথা সেই বয়সে তার চেহারায় ক্লান্তির চাপ। রোদে মুখ কালো হয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে দুটি ঠোঁট। বাম কাঁধে একটি লাঠি। সাথে রোদের তাপদাহ থেকে বাছতে লাঠির সাথে আরেক হাতে রেখেছে একটি ছাতা। তার সাথে আলাপ কালে সে বলে,গরু রাখতে আমার ভালো লাগে পড়ালেখা করতে ভালো লাগে না পড়ালেখা করতে টাকা লাগে। বাবা অন্যের বাড়িতে চাকরি করেন আর আমি অন্যের গরু রাখি।দৈনিক ৫ কেজি ধান ও ১৫০ টাকা নগদ পাই তা দিয়ে সংসার খরছের জন্য বাবাকে সহযোগীতা করি।
একই হাওরে গরু নিয়ে খেলা করছে রফিনগর ইউনিয়নের সজনপুর গ্রামের নরছল মিয়ার ছেলে লিটন মিয়া (১৩) খালি পায়ে, হাতে লাঠি, কাদে খাবারের ব্যাগ নিয়ে হাটছে। অন্য হাতে ধরে রেখেছে ছড়ানো ছাতা। আলাপ কালে লিটন মিয়া বলে,আমার পরিচয় আমি রাখাল। মানুষ আমাকে রাখাল বলেই ডাকে এতে আমি মোটেও বিরক্তবোদ মনে করি না।আমি সংসারের অভাবের তাড়নায় এই পেশা বেছে নিয়েছি। পড়ালেখার কথা চিন্তায় আসেনা কারন মা, বাবা মানুষের বাড়িতে কাজ কাম করেন তাই আমিও এলাকার বিভিন্ন জনের গরু রাখালের কাজ করি, এতে করে আমি ৬ মাস পর ৪০ মন ধান পাই। সংসার আমাদের এভাবেই চলছে।
এদিকে অন্যান্য রাখাল শিশুদের সাথে আলাপ কালে বুঝা যায়, বাড়ি থেকে ৩-৪ কিলোমিটার পথ প্রতিদিন হেঁটে যায় তারা। খোলা আকাশের নিচে ঘাসযুক্ত মাঠে ছেড়ে দেবে গরুর পাল। ইচ্ছেমতো ঘুরবে আর ঘাস খাবে। লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবে এসব শিশু রাখালরা। পিপাসা পেলে খাল বিলের পানিই ভরসা। পরিচ্ছন্নতার কোনো বালাই নেই। হঠাৎ ঝড়ে জীবন বাঁচাতে শিশুরা মাটিতে বসে অথবা শুয়ে পড়ে। গরুও বাঁচাতে হবে। নিজেকেও রক্ষা করতে হবে। অন্য শিশুরা স্কুলে গেলেও তারা যেতে পারছে না। বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে না। শিশু রাজিব বর্মন বলে, যখন মেঘবাদলের দিন আসে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে বিদ্যুৎ চমকানি ও বিকট শব্দে ভয়ে শরীরে কম্পন শুরু হয়। অনেক সময় গরুর আঘাতে আহত হতে হয়। এক প্রশ্নে সে জানায়, পড়া লেখা নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, হাওর এলাকার অনেক ছাত্র-ছাত্রী ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা করতে ইচ্ছে থাকলেও সংসারের অভাবের কারণে তাদের আর পড়ালেখা হয়ে উঠে না। এদের কেউ হাওরে গরু রাখে আবার কেউ বাজারের বিভিন্ন দোকানে চা স্টলে কাজ করে।
দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ইয়াসিন আরাফাত বলেন, এমন অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলে শিশুরা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। শারীরিক গঠন কাঠামোতে সমস্যা হতে পারে।