সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে মাঠ জরিপ শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২২টি টিম বৃহস্পতিবার থেকে সারা জেলার প্রকল্পাধীন হাওরের জরিপ কাজের মাধ্যমে প্রাক্কলন করছে। কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ এর আলোকে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই পিআইসি (কৃষকদের নেতৃত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন শেষ করে কাজ শুরু করার কথা। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে মন্ত্রণালয় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে এবার ৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের জরিপ কাজ পরিচালনা করছে। অন্যান্য হাওরেও সহকারী প্রকৌশলী ও উপসহকারী প্রকৌশলীরাও প্রি-ওয়ার্ক করছেন। এদিকে হাওরের কৃষকরা কাবিটা নীতিমালার আলোকে প্রকৃত কৃষকদের সমন্বয়ে পিআইসি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিবর্জিত পিআইসি সদস্য নিযুক্তির দাবি জানিয়ে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জের সকল হাওরের শতভাগ ফসল আগাম বন্যায় ডুবে যায়। ঠিকাদারদের অনিয়ম, দুর্নীতি আর গাফিলতিতে ফসলহানির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন হাওরবাসী। সারাদেশেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। চালের দাম সারাদেশেই বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষক-জনতার দাবির প্রেক্ষিতে সরকার কাবিটা নীতিমালা সংশোধন করে। এই নীতিমালায় ঠিকাদারি প্রথা বিলুপ্ত করে প্রকৃত কৃষকদের নেতৃত্বে এমপি’র প্রতিনিধি খর্ব করে পিআইসি’র মাধ্যমে কাজ বাস্তবায়নের নীতিমালা জারি করে। গত দুই বছর ওই নীতিমালার আলোকেই হাওরের কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ আছে প্রচ্ছন্নভাবে এখনো এমপিদের প্রতিনিধিরাই ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে রয়ে গেছেন। যে কারণে বাঁধের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েই গেছে। নতুন নীতিমালায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকেও যুক্ত করা হয়। প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফসলরক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন উপজেলা কমিটির সভাপতি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপসহকারী প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধেও গত দুই বছর পিআইসি গঠনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বৃহত্তম ৩৭টি হাওরে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে ৯২ কোটি টাকা বরাদ্দে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল ৫৭২টি। ওই বছর ৪৫০ কি.মি. বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছিল। তবে এ বছর পিআইসি সংখ্যা এখনো নির্ধারণ করা না হলেও প্রাথমিকভাবে ৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত সপ্তাহে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ নিয়ে জেলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই ফসলরক্ষা বাঁধের কাজের প্রিওয়ার্ক জরিপ শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২২টি টিম ৩৭টি হাওরের বাঁধের কাজের প্রাক জরিপ বাস্তবায়ন করছে বলে জানাগেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশিরভাগ হাওরেরই এখনো পানি নামেনি। তাই বাঁধের প্রাক জরিপ করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তবে যেগুলোর পানি নেমে গেছে সেগুলোর প্রাক্কলন করা হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যেই প্রিওয়ার্ক শেষ করে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরুর করার কথা। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সম্পূর্ণ কাজ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন হাওরের পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় জরিপ কাজেও বিলম্ব হবে। তাই কাজ বাস্তবায়নও কিছুটা বিলম্ব হতে পারে।
এদিকে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ কাবিটা নীতিমালার আলোকে বাস্তবায়ন ও পিআইসি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতারা। কৃষক সংহতির আহ্বায়ক এডভোকেট রুহুল তুহিন বলেন, আমাদের দাবি নীতিমালার আলোকে প্রকৃত কৃষকদের দিয়ে পিআইসি গঠন করতে হবে। কাজ যাতে প্রাক্কলন অনুযায়ী যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে শেষ হয় সেই দিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই পিআইসি গঠনে বিলম্ব হয়। এ কারণে বাঁধের কাজেও বিলম্ব হয়। পরে নামকাওয়াস্তে কাজ করে বরাদ্দ লোপাট করা হয়। ফসলও ঝুঁকিতে থাকে।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, প্রকৃত কৃষকদের নেতৃত্বে পিআইসি গঠন করার কথা থাকলেও বাস্তবে এখনো সংসদ সদস্যদের লোকদের দাপট রয়েছে। প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাই এই সুযোগ করে দেয়। আমরা এবারও লিখিভভাবে জানিয়েছি প্রকৃত কৃষকদের নেতৃত্বে পিআইসি গঠন করে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ বাস্তবায়নের জন্য।
ফসলরক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আমাদের ২২টি টিম ৩৭টি হাওরেই প্রিওয়ার্ক শুরু করেছে। কিছু হাওরে পানি বিলম্বে নামায় জরিপ করতে সমস্যা হচ্ছে। তবে এবছর নির্দিষ্ট সময়েই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
admin
২:৫৪ পূর্বাহ্ণ