ভারতীয় উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। বিচারের এই পরিক্রমায় হিন্দু, মুসলিম ও বৃটিশ শাসনামলের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। প্রাচীন ভারতের বিচারিক কার্যক্রম হিন্দু শাস্ত্রের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হত। খ্রিস্টীয় এগার শতাব্দীতে ভারতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। সুলতানি এবং মুঘল আমলে শরীয়া অনুযায়ী বিচারকাজ সম্পন্ন করা হত। কাজী ক্ষেত্রবিশেষে মুফতির সহায়তায় কাজ বিচারকাজ পরিচালনা করতেন। সম্রাটের আদালত ছিল সর্বোচ্চ বিচারালয়। মুঘল আমলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হত। তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এ বিচার ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। ধীরে ধীরে মুঘলদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে এবং উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনৈবেশিক শাসনের সূচনা হয়।
১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানী প্রথম এলিজাবেথ একটি চার্টারের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতবর্ষে ব্যবসা করার একচ্ছত্র অধিকার দেন। পাশাপাশি কোম্পানিকে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়। ১৬১৬ সালে ২৪ জানুয়ারি সুরাট বন্দরে নোঙ্গরকৃত জাহাজে কোম্পানি সর্বপ্রথম ফৌজদারি বিচারকার্য শুরু করে। এক ইংরেজ নাগরিককে খুনের দায়ে গ্রেগরি লেলিন্টন নামে এক ব্যক্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ক্রমান্বয়ে কোম্পানির বিচারিক ক্ষমতা উন্মুক্ত সমুদ্রের পাশাপাশি ভারতীয় ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়। পরবর্তীতে ১৬৬১ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস কোম্পানির আওতাধীন এলাকায় দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বৃটিশ আইন প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করেন। ১৭২৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাজা প্রথম জর্জ কোম্পানি কতৃক বিচার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বৃটিশ আইনের প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করেন। ১৭২৮ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে মেয়র’স কোর্ট এবং কোর্ট অব অয়ার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফৌজদারি বিষয়ে মেয়র’স কোর্ট ও দেওয়ানী বিষয়ে কোর্ট অব অয়ার বিচারকার্য পরিচালনা করত। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। ফলশ্রুতিতে ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা, বিহারের এবং উড়িষ্যা দেওয়ানী লাভ করে। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে বেঙ্গল রেগুলেশন-২ এর মাধ্যমে প্রচলিত আদালত ব্যবস্থার সূচনা করেন। রেগুলেটিং এক্ট ১৭৭৩ অনুসারে ১৭৭৪ সালের ২৬ মার্চ কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে সুপ্রিম কোর্ট অব জুডিকেচার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৭ সালে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে। শুরু হয় বৃটিশ রাজের শাসন।
১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান হাইকোর্টস এক্ট এর আওতায় ১৮৬২ সালের ১ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬০ থেকে পরবর্তী ৫০ বছরে উপমহাদেশে অদ্যাবধি প্রচলিত মূখ্য আইনসমূহ (দণ্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন, ফৌজদারি কার্যবিধি, চুক্তি আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি ও তামাদি আইন) প্রণয়ন হয়। সমগ্র ভারতে সাব-ডিভিশনাল এবং ডিসট্রিক্ট আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে সীমিত এখতিয়ারসম্পন্ন ফেডারেল কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী ঔপনৈবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। ভারত ও পাকিস্থান-দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৪৭ সালের হাইকোর্ট অব বেঙ্গল অর্ডার অনুযায়ী ঢাকা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আজও ৩ টি দেশের বিচার ব্যবস্থা এবং মৌলিক আইনসমূহ একই।
শত শত বছর ধরে চলে আসা এ বিচারব্যবস্থা তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে প্রায় বিকল। বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা, লাল ফিতার দৌরাত্ব, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, বিদ্যমান এনালগ ব্যবস্থা ন্যায়বিচারের পথে প্রধান অন্তরায়। ঝুলে আছে ৩৬ লক্ষ মামলা। অপচয় হচ্ছে কর্মঘন্টা, অর্থ। মামলার রায়-আদেশ সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছে পৌছাঁতে এক/দুই সপ্তাহ এবং এমনকি মাসও লেগে যায়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে হয় অপ্রত্যাশিত বিলম্ব। যেমনঃ- তিন বছর পর গুলশান ক্লাব মামলার রায় প্রকাশিত হয়। ১৬ মাস পর ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার পূর্ণাংগ রায় প্রকাশ হয়। রেকর্ডরুমের এনালগ ব্যবস্থাপনার কারণে গুরুত্বপূর্ণ নথি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ৮ মে ২০১৮ সালে হাইকোর্টের নথি গায়েব নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোয় পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। নথি গায়েবের ফলে দুদক ৫ বছর আপিল দায়ের করতে পারেনি। অধিকন্তু, আদালতে দুরবর্তী সাক্ষী/ আসামী/ অন্যান্য পক্ষের শারীরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে ভুক্তভোগী বিচার প্রার্থীদের মামলার চূড়ান্ত ফলাফল/ডিক্রি পেতে অপেক্ষা করতে হয় যুগের পর যুগ। স্কলাস্টিকা ছাত্রী শাজনিন হত্যার বিচার শেষ হতে সময় লেগেছে ১৮ বছর; চাপা হত্যার চুড়ান্ত ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৬ বছর। এই দীর্ঘসূত্রিতা থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক কার্যক্রমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার।
বিদ্যমান বিচারিক ব্যবস্থার সকল যোগাযোগ, ফাইলিং, সাক্ষ্য-প্রমাণ রেকর্ডিং ও সংরক্ষণ, মামলার নথি সংরক্ষণ, আদেশ-রায় প্রেরণ ও প্রদর্শন ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব। ক্ষেত্র বিশেষে পক্ষদ্বয় অডিও-ভিডিও-এর মাধ্যমে শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। মামলার নথি, আদেশ, রায়সহ অনান্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ডিজিটাল স্বাক্ষর ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় ই-জুডিশিয়ারি চালু হয়েছে। অস্ট্রিয়ায় ১৯৯৯ সাল থেকে ই-কোর্ট ব্যবস্থা সুচারুভাবে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে ২০০১ সাল থেকে মামলার নথি, আদেশ, রায় অনলাইনে পাওয়া যায়। মামলার যুক্তিতর্কের অডিও ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র্বের ফেডারেল বিচার ব্যবস্থায় ই-কোর্ট ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। ২০১৬ সালে নিউইয়র্কে থাকাকালীন কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার দায়ে পুলিশ অফিসার লি-এর বিচার সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছিল। বিচারিক আদালতে অডিও-ভিডিও রেকর্ড, সাক্ষীর জেরা-জবানবন্দি সংরক্ষণে সয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া আমাকে মোহিত করেছে। ২০০৮ সালে মালেশিয়ায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে কুয়ালালামপুরে দুইটা হাইকোর্টে ই-কোর্ট ব্যবস্থা চালু হয়। ২০১১ সালের মার্চ মাস থেকে সমগ্র মালেশিয়ায় ই-কোর্ট ব্যবস্থার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৪ জুন তারিখ থেকে ফিলিপাইনের বিচারিক আদালতে ই-কোর্ট চালু রয়েছে। ২০১৭ সালের ৪ মে থাইল্যান্ডে ই-জুডিশিয়ারি চালু হয়। থাইল্যান্ডে ই-ফাইলিং, ই-সার্ভিসের পাশাপাশি ই-পেমেন্ট ব্যবস্থাও চালু করা হয়।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০৫ সাল থেকে ই-জুডিশিয়ারির কার্যক্রম চালু হয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্রচলিত হার্ডকপি ফাইলিং–এর পাশাপাশি ই-ফাইলিং ব্যবস্থা চালু আছে। সুপ্রিম কোর্টের এবং হাইকোর্টের দৈনন্দিন কার্যতালিকা, সকল আদেশ-রায়, বিভিন্ন সার্কুলার, নির্দেশনা অনলাইন নোটিশ বোর্ডে পাওয়া যায়। বিচারপতিদের পরিচয়, ১৯৯৭ সালে ১৭ মে সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভার সিন্ধান্ত অনুসারে সম্পদের বিবরণ অনলাইনে প্রকাশিত হয়। নিম্ন আদালতে ই-কোর্ট ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। ই-ফাইলিং ও ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা কার্যকর আছে। দৈনন্দিন কার্যতালিকা, সকল আদেশ-রায়, বিভিন্ন সার্কুলার, নির্দেশনা অনলাইন নোটিশ বোর্ডে পাওয়া যায়। বিচারকের ছুটির বিষয় ডিজিটাল মাধ্যমে জানা সম্ভব। ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট স্বপ্নিল ত্রিপটি বনাম সুপ্রিম কোর্ট অব ইন্ডিয়া, (২০১৮) ১০ এস সি সি ৬৩৯- মামলায় সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের প্রসিডিং লাইভ সম্প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। কারণ,বিচার কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করা নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
বর্তমান বাংলাদেশে বিচারিক ব্যবস্থায় কিছু কিছু কার্যক্রম ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে উচ্চ আদালতের উভয় বিভাগের মামলার তথ্যাদি, দৈনন্দিন কার্যতালিকা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানা সম্ভব। ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে জামিন আদেশ যাচাই করা যায়। সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ রায়, আদেশ প্রদর্শিত হয়। ২০১৫ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট অনলাইন বুলেটিন প্রকাশিত হয়। ২০১১ সাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার, আদেশ, নির্দেশনা অনলাইন নোটিশ বোর্ডে পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়। জুডিশিয়াল পোর্টালে দেশের বিভিন্ন মহানগর এবং জেলায় আদালতসমূহে কর্মরত জুডিশিয়াল অফিসারদের তথ্য বিদ্যমান। মন্ত্রনালয়ের অনলাইন নোটিশ বোর্ডে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ এবং নিম্ন আদালতে জুডিশিয়াল অফিসার নিয়োগ, বদলি, ছুটিসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ আদেশ অনলাইনে প্রকাশিত হয়।
২০১১ সালে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইউএনডিপির অর্থায়নে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রমে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু ২০১৫ সালের পর উক্ত প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। উচ্চ আদালতের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার উক্ত প্রকল্পেরই অবদান। ২০১৫ সালে ১৮ জানুয়ারি তারিখে সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বিচার বিভাগের জন্য ৫ দফা স্ট্রাটেজি ঘোষণা করেন। তমধ্যে বিচার প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার অন্যতম। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বার বার ই-জুডিশিয়ারির উপর গুরুত্বারোপ করেন। নিম্ন আদালতে সফরে যাওয়ার সময় তিনি ৫/৬ টা কম্পিউটার সাথে করে নিয়ে যেতেন। সুপ্রিম কোর্ট বাজেট থেকে তা সরবরাহ করা হত। ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সিলেট ম্যাজিট্রেসিতে পাইলট ই-কোর্ট চালু করেন। তিনি তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে এই প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের কথা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়য়ের টানাপোড়নে সরকার ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প অনুমোদন করেনি।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ২৬৯০ কোটির টাকার ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের মূল কার্যক্রমগুলো হল অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ই আর পি সফটওয়ার, ভিডিও কনফারেন্স সাক্ষ্য রেকর্ড, ডিজিটাল সাক্ষ্য রেকর্ডিং, ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন),আইন মন্ত্রাণালয়ের ডাটা সেন্টার, মন্ত্রাণালয়ের নেটওয়ার্ক সেন্টার, সুপ্রিম কোর্ট ডাটা সেন্টার, সুপ্রিম কোর্ট নেটওয়ার্ক সেন্টার, ১৪০০ ই-কোর্ট প্রতিষ্ঠা, ৬৩ জেলায় মাইক্রো ডাটা সেন্টার, মন্ত্রাণালয়-সুপ্রিম কোর্ট আন্তঃ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, ২০০০ ট্যাব-লাপটপ প্রদান, কোর্টের সকল রেকর্ডরুম অটোমেশন, কেস রেকর্ডস এবং রায় ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষন, বায়োমেট্রিক এটেন্ডেন্স, ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের ১৭০ জন জনবল নিয়োগ। এই প্রকল্প এ বছর মার্চ মাসে একনেকে অনুমোদন হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে সম্ভব হয়নি। এভাবে প্রায় ৩ বছর শ্লথ গতিতে চলছিল ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম।
১৯ জানুয়ারি, ২০২০ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জনাব ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুইয়্রা কতৃক দায়েরকৃত এক রিট আবেদনের শুনানি অন্তে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সারাদেশের আদালতে ই-জুডিশিয়ারি ও ই-কোর্ট রুম দ্রুত স্থাপনে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। পাশাপাশি ৯০ দিনের মধ্যে ই-জুডিশিয়ারি স্থাপনের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন আদালত।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারনে গত ২৯ মার্চ থেকে সুপ্রিম কোর্ট এবং সকল অধঃস্তন আদালতের স্বাভাবিক বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। গত ৯ মে তারিখে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার অর্ডিন্যান্স জারি করেন। উক্ত অর্ডিন্যান্সের আলোকে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্য গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট উচ্চ আদালত এবং অধঃ স্তন আদালতের জন্য পৃথক পৃথক প্র্যাকটিস নির্দেশনা জারি করেন। প্র্যাকটিস নির্দেশনা অনুযায়ী অধঃস্তন আদালতকে শুধু জামিন শুনানির ক্ষমতা দেওয়া হয়। গত ৩১ মে সুপ্রিম কোর্ট অধঃস্তন আদালতের জন্য আরেকটি নির্দেশনা জারি করেন। নির্দেশনায় পূর্বের প্র্যাকটিস নির্দেশনা অনুসরন করে অধঃস্তন আদালত সমুহকে অতীব জরুরী বিষয়ে শুনানির ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই পদক্ষেপকে দেশের ই-জুডিশিয়ারি স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাইফলক হিসেবে মনে করা হচ্ছে। তবে ভার্চুয়াল কোর্ট বিদ্যমান আদালত ব্যবস্থার বিকল্প নয়। বিদ্যমান আদালত ব্যবস্থায় শারীরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করে বিচার কার্য পরিচালিত হয়। কিন্তু মহামারী বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সময় শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা সম্ভব হয় না। এই সময়ে বিচারকার্য সচল রাখার একটি পদ্ধতি ভার্চুয়াল কোর্ট ব্যবস্থা। এটি ই-জুডিশিয়ারির একটি অন্যতম উপাদান। ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার জন্য ‘আমার আদালত’ ওয়েব পোর্টাল খোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে ই-ফাইলিং চালু হয়েছে।
১১ জুন অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০২০-২১ বাজেট অধিবেশনে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পের জন্য বরাদ্ধ রাখা হয়েছে বলে জানান। তিনি সংসদে বলেন, ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন হলে সময় এবং ব্যয় দুটোই কমবে। বিচারপ্রার্থীরা সুবিধা ভোগ করবে। তিনি আরও জানান, একটি কেন্দ্রীয় কেস ব্যবস্থাপনা নেটওয়ার্ক্রে মাধ্যমে বিচারিক কর্মকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষ, থানা পুলিশ, হাসপাতাল, জেল প্রসিকিউটর, তদন্তকারী কর্মকর্তা সবাই সংযুক্ত থাকবে। গত ২১ জুন একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সকল জেলা কারাগার সমূহে ভার্চুয়াল সিস্টেম চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসামীরা আদালতের সাথে সংযুক্ত হতে পারবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী খুব শীগ্রই বাস্তবায়ন শুরু হবে ই-জুডিশিয়ারি কার্যক্রম।
ই-জুডিশিয়ারি প্রায়োগিক সাফল্য নিশ্চিত করতে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। বিদ্যমান হার্ডকপি ফাইলিং-এর পাশাপাশি ই-ফাইলিং চালু রাখা; অধঃস্তন আদালতের দৈনন্দিন মামলা তালিকা অনলাইনে প্রকাশ করা; অধঃস্তন আদালতের সকল আদেশ এবং রায় অনলাইনে প্রকাশ করা; ডিজিটাল সাক্ষ্য রেকর্ডের ব্যবস্থা করা; ই-কোর্টের মাধ্যমে রেকর্ডকৃত ওরাল আর্গুমেন্ট অনলাইনে প্রকাশ করা; মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষ, সাক্ষী যাদের আদালতের সামনে উপস্থিত করা সময়সাপেক্ষ/ ব্যয়সাপেক্ষ, তাদের সাক্ষ্য বা বক্তব্য অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহন করা; মামলার নথি এবং গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-রায়ের নকলের আবেদন অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা; কোর্ট ফি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ফি অনলাইনে(ই-পেমেন্ট) সম্পন্নের ব্যবস্থা গ্রহন করা; বিদ্যমান কেস ট্রেকিং ব্যবস্থাকে আরও কার্যকরী করা; সুপ্রিমকোর্টে পরিচালিত মামলার শুনানির লাইভ স্ট্রিমের ব্যবস্থা গ্রহন করা; সুপ্রিম কোর্টের হার্ডকপি কজলিস্ট প্রিন্ট বন্ধ করা; ডিজিটাল স্বাক্ষরের প্রচলন,ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড, অনলাইন লাইব্রেরি, প্রশিক্ষণ, থানা-আদালত-জেলের মধ্যে ই-যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রচলন করা, অনলাইনে এফ আই আর দায়েরের ব্যবস্থা, মেইনটেনান্স ব্যবস্থা চালু, সকল আসামী/ দণ্ডিতের ডিজিটাল ডাটাবেজ সম্পন্ন করা, ডিজিটাল জমি ব্যবস্থাপনার সাথে আদালতের মধ্যে একটি আন্তঃ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা, বিদ্যমান জুডিশিয়াল পোর্টালকে আপডেট করা এবং মৌলিক আইনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধন।
করোনা মহামারীর ব্যাপকতা ই-জুডিশিয়ারির প্রয়োজনীয়তা আরো একবার স্মরণ করিয়ে দিল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা প্রতিভাত হয়েছে। প্রায় দেড় মাস রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ বিকল অবস্থায় ছিল। ভার্চুয়াল কোর্ট এ স্থবিরতা দুর করেছে। ভার্চুয়াল আদালতের প্রথম ২০ দিনে ৩০ হাজার বন্দী জামিনে মুক্তি পেয়েছে। ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়নের চলমান এ কার্যক্রম এবং উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে বিচার প্রার্থীর পাশাপাশি বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকলে উপকৃত হবেন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। দীর্ঘসূত্রিতা লাঘব হবে; মামলা জট কমবে। সর্বোপরি বিচার ব্যবস্থায় সামগ্রিক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
মোহাম্মদ শিশির মনির
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সঙ্গে
মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন
এডভোকেট, জজ কোর্ট, ঢাকা।