ইমরান হোসাইন: ভূমি নেই-ঘর নেই এমন নিঃস্ব মানুষকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ মাধ্যমে জমির সঙ্গে স্থায়ী সেমিপাকা ঘরের মালিকানা দেয়ার যে ‘নজিরবিহীন’ কর্মসূচি শুরু করেছেন। গত জানুয়ারিতে প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারকে ঘর প্রদানের পর দ্বিতীয় পর্যায়ের রোববার(২০ জুন) ঘর প্রদান করা হয়েছে। সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় ১৯৮১ টি ঘর নির্মান হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঘর নির্মাণের সাথে সাথে তালিকাভূক্ত উপকারভোগিরা নির্মিত ঘরে বসবাস শুরু করেছেন। এসব ঘর নির্মাণ কাজের শুরুতেই অনিয়ম ও দূর্নীতি হচ্ছে এমন নানান অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপকারভোগী পরিবারের লোকজনের। একাধিক ঘরে ফাটলের কারণে উপকারভোগিরা প্রাণভয়ে স্বপ্নের বাড়িতে বসবাস না করে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন। গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশের পর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের তদন্তে প্রমাণিত হয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে গেল ৭ জুন কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক । তাছাড়া দরিদ্র গৃহহীনদের দেওয়া পরিবহন খরচের ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকাও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক গত ৬ জুন ফেরত দেওয়া হয়েছে।
দিরাই ও শাল্লা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দিরাই উপজেলায় ৫৪৬ টি ও শাল্লা উপজেলায় ১৪৩৫ টি ভূমিহীন গৃহহীন পরিবারে দুই শতাংশ জমিতে ঘর নির্মাণ কাজ চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঘর নির্মাণের সাথে সাথে তালিকাভূক্ত উপকারভোগিরা নির্মিত ঘরে বসবাস শুরু করেছেন। সরেজমিনে ঘর নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপকারী পরিবার গুলোর সাথে আলাপকালে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এই মহৎ উদ্যোগে দেশব্যাপী উপকারভোগী পরিবারগুলো ঘর প্রাপ্তির খবরে আনন্দিত হলেও হাওরাঞ্চলের এ জনপদে এর ব্যতিক্রম। এ অঞ্চলের উপকারভোগির তালিকা তৈরী থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘর নির্মাণে ধাপে ধাপে ঘুষ দিতেই হচ্ছে ভূমিহীন পরিবারগুলোকে। ঘর নির্মাণে নিম্ন মানের ইট, রড, সিমেন্ট, কাঠ ও দরজা জানালায় ষ্টীলের পরিবর্তে হালকা পাতলা প্লেন সীট ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ ঘরের মেঝেতে সলিং দেয়া হয়নি। বাথরুমের কমোড পাইপ, রিং কোন কিছুই দেয়া হয়নি। অথচ প্রতিটি বাথরুম ও মূলঘরের ফ্লোর সলিং এর জন্য ২০ হাজার টাকা বরাদ্ধ রয়েছে। ঘর নির্মানে সলিং বাথরুমের টাকা সংশ্লিষ্টদেও পকেটে যাচ্ছে। নিম্ন মানের ইট, ভিটে বালু ও সিমেন্ট কম দেয়ায় অধিকাংশ ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটলের কারনে একাধিক উপকারভোগি প্রাণভয়ে স্বপ্নের বাড়িতে বসবাস না করে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় সকল ঘর নির্মাণ ও ক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এককভাবে পরিচালনা করছেন। নির্মাণের মালামাল পরিবহনের টাকা গৃহহীনদের উপর চাপিয়ে দেওয়া, মিস্ত্রির মজুরীর টাকা ও থাকা খাওয়ার খরচ গৃহহীনদের দিতে বাধ্য করাসহ নানাভাবে অসহায় মানুষজনের কাছ থেকে টাকা নেবার অভিযোগ ওঠে। ফলে প্রধানমন্ত্রী দেয়া উপহার স্বপ্নের ঠিকানা পেয়ে আশ্রয়হীন এসব মানুষেরা যে পরিমাণে আনন্দিত হওয়ার কথা তাদের মাঝে সেই আনন্দের ঝিলিক নাই।
সরেজমিনে চরনারচর ইউনিয়নের কামান বিলের পাড়, রাজানগর ইউনিয়নের রনারচর গ্রামে পরিদর্শনকালে লক্ষ করা যায় প্রত্যেকটি ঘরের চালের টিন ছোট হওয়ায় বৃষ্টি হলে পার্শ্ব হতে ঘরের ভিতর পানি ঢুকে। প্রত্যেকটি ঘরের টয়লেটে নিম্নমানের প্লাস্টিকের কমোড দেয়া হয়েছে। বারান্দা ও ঘরের চালার কাঠের বর্গা ৩.৫ ফিট দেয়া হয়েছে। কামান বিলের পাড় ৫৯ ঘরের মধ্যে ৬ টি ঘরের দেয়াল ও মেঝেতে ফাটল, ১ টি ঘরের আস্তর উঠে যাচ্ছে এবং কোন ঘরে বাথরুম দেয়া হয়নি। এর মধ্যে ঝুনু মাহিষ্য দাস ঘরের দেয়াল এবং ফ্লোরে ফাটল দেখা দিয়েছে। হিরা লাল দাস ঘরের বাহিরের অংশের আস্তর হাতের ঘষায় ঝরে পড়ছে। রিনা রাণী বিশ্বাসের ঘরের ভিতরের অংশের দেয়াল ফাটল দেখা দিয়েছে। রতিস বিশ্বাস এবং রসময় বিশ্বাসের ঘরের দেয়াল ভিতর ও বাহিরে ফাটল দেখা দিয়েছে। নিশি বৈষ্ণব এর ঘরের দেয়াল ফাটল ও ফ্লোরের আস্তর উঠে যাচ্ছে। করিমপুর ইউনিয়নের চান্দপুর ও জয় নগর ৪ টি ঘরে ফাটল রয়েছে। উপকারভোগি বাবুল বমর্নের ঘরের দেয়াল এবং ফ্লোর ফাটল দেখা দিয়েছে। লিটন বর্মন ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। বিধবা সখী বর্মনের ঘরে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। চান্দপুর এবং জয় নগর ৩৩ ঘরে বাথরুম দেয়া হয়নি। রাজানগর ইউনিয়নের রন্নারচর গ্রামে ৭ টি ঘরে দেয়াল ও ফ্লোর ফাটল, সবগুলো ঘরের টিন ছোট দেয়ায় বৃষ্টি হলে পার্শ্ব হতে পানি ঢুকে,বাথরুমে নিম্নমানের প্লাস্টিকের কমড দেয়া হয়েছে। ফাটল দেয়া ঘরের উপকারভোগি বিধবা মরিয়ম বিবি দেয়াল ফাটল এবং ঘরের টিন ছোট দেয়ার কারণে ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকার কারনে রাতে অন্যত্র বসবাস করেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান। তাছাড়া আব্দুল রহমান ঘরের দেয়াল এবং বারান্দার পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। নুর উদ্দিন, খলিল মিয়া ঘরের দেয়াল ফাটল দেখা দিয়েছে। আবু তাহের, ঝর্ণা বিশ্বাসের ঘরের দেয়াল ও ফ্লোরে ফাটল দেখা দিয়েছে। উপকারভোগি জাহেদ মিয়া ঘরের দেয়াল ও ফ্লোরে বড় ধরনের ফাটল দেখিয়ে বলেন দিনের বেলা ঘরে থাকলেও ঝড় আসলে বা রাতের বেলা ভয়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে পাশের ঘরে বসবাস করেন। একই চিত্র শাল্লা উপজেলার নির্মাণ করা ঘর গুলির। উপজেলার শান্তিপুর ,সুখলাইন, মন্নানপুরসহ একাধিক এলাকা পরিদর্শনে গেলে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র ফুটে ওঠে। গত চার ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক মো.জাহাঙ্গীর হোসেন ৩ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও ২০ জন ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে নিয়ে শাল্লায় তদন্তে যান। একাধিক দলে ভাগ হয়ে নির্মাণাধীন গৃহহীনদের ঘরে ঘরে সরেজমিন যান তাঁরা। ২০ ফেব্রুয়ারি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণসহ ২৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট ওখানকার নির্মাণাধীন প্রত্যেক ঘরে ঘরে যান।
এরপর আরও দুই দফায় জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ২৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট ওখানে দিনব্যাপি গিয়ে তদন্ত করেন। তদন্তকালীন সময়েই গৃহ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মামুনুর রহমানকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন যেসব ঘরে ইট সলিং না করে মেঝে পাকা করা হয়েছে, সেগুলোতে ইট সলিং করে মেঝে পাকা করার নির্দেশ দেন। পরিবহন খরচ এবং মিস্ত্রি খরচের টাকা দরিদ্র মানুষজন যারা নিজেরা দিয়েছে, ওই টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেন। শাল্লা উপজেলার নারকিলা গ্রামের উপকারভোগি নজরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বললেন, তাদের ঘরে মেঝের বালু-সিমেন্টের আস্তরণ তুলে ইট সলিং করে ঢালাই করে দেওয়া হচ্ছে। পরিবহন ও মিস্ত্রি খরচের জন্য যে টাকা তারা দিয়েছিলেন, সেই ৭ হাজার টাকা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য এলাছ মিয়া তাদেরকে ফেরত দিয়েছেন। জানা যায়, জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অনুযায়ী শাল্লার নির্মান কাজে অনিয়ম হওয়া ঘরগুলোতে এখন পুনরায় কাজ চলছে।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মুক্তাদীর হোসেন বলেন, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে অন্যান্য উপজেলা এবং শাল্লার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অন্য উপজেলায় ঠিকাদাররা গৃহনির্মাণ করেছে। এই উপজেলা প্রত্যন্ত হওয়ায় এখানে বেশিরভাগ উপকারভোগীরা মালামাল পরিবহন করেছে। পরিবহনের বরাদ্দ শুরুতে আসে নাই, এজন্য দিতে পারি নাই, এখন এসেছে, ১৪৩৫ ঘরের প্রত্যেককেই চার হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকাই গেল ৬ জুন গৃহহীনদের দিয়েছি । দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান মামুনের বক্তব্য নিতে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি কেটে দেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দরিদ্র মানুষজনের উপহারে একটি টাকার অনিয়মও সহ্য করা হবে না।শাল্লায় প্রথমেই ৪ ফেব্রুয়ারি ৩ জন এডিসি, ১১ ইউএনওসহ ২০ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে ওখানে যাই, বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে দিনভর বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনিয়মের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করেছি। এরপর বিভাগীয় কমিশনার স্যারসহ ২৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট, পর্যায়ক্রমে ২৪ জন এবং সর্বশেষ ১৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট সরেজমিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনিয়ম যাচাই করেছেন। আমাদের চোখে নানাবিধ ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ে, আমরা সেগুলো সংশোধন করিয়েছি, এখনো সংশোধনের কাজ চলছে। শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। তাকে ৭ জুন শোকজ করা হয়েছে। শোকজের জবাব পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।