সরকারি তথ্যমতে, সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ কৃষক বোরো চাষাবাদ করেন। গেল মৌসুমে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ১৭ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে, আবাদ হয়েছিল দুই লাখ ২৪ হাজার ৪০ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিল ১৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ মে. টন ধান।
হাওরের কৃষকরা বলছেন, ক্ষেতে ধান ফলনে ভালো হলেও গত কয়েক বছর ধরে লোকসানে বিক্রি করতে হয়। পর্যায়ক্রমে এই লোকসানে পূর্বের বড় কৃষক হয়েছেন মাঝারি কৃষক, মাঝারি কৃষক হয়েছেন ছোট কৃষক এবং ছোট কৃষক নিঃস্ব হয়ে ক্ষেত মজুরে পরিণত হয়েছেন।
হাওরের বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের কাছ থেকে জানা যায়, কৃষকের প্রতিমণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হয় ৯৩১ টাকা। বৈশাখ মাসে প্রতিমণ ধান বিক্রি করতে হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা করে। এতে মণ প্রতি ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা লোকসান দিতে হয় তাদের।
গেল বছরে ১০৪০ টাকা ধরে প্রতি মণ ধান
কিনেছে সরকার। ১৭ হাজার ৮০০ মে.টন ধান ও প্রায় ৩১ হাজার মে.টন চাল কেনা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ধান মিল মালিকরা দিতে পেরেছেন।
তাহিরপুর থেকে পড়তে আসা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র মো. সামায়ূন কবির বলেন, আমার বাবা একজন কৃষক। ধান বিক্রি করে আমাদের পড়াশুনা সহ পরিবারের অন্যান্য খরচ চলে। আমরা শনির হাওরে জমি চাষ করি। গত বছর ৭ কেয়ার রং জমা নিয়েছিলেন বাবা। এবার নিয়েছেন ২ কেয়ার। কারণ জমি করে লোকসানে পড়তে হয়।
দিরাই থানার কৃষক হিরন্ময় দাস বলেন, শাল্লার পোটকা হাওরে ১ হাল (১২ কেয়ার) জমি আছে আমার। কিছু জমি আমি সব সময় রংজমা দিয়ে দেই। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত কেউ রংজমা নিচ্ছেন না। সবাই বলে জমি করে আরো লোকসান। এখন পতিত থাকার উপক্রম হয়েছে।
জগন্নাথপুরের কৃষক মো. নজরুল মিয়া বলেন, গত বছর পুলার হাওরে ৩৬ কিয়ার জমি করছি। নিজের আরো ৯ কিয়ার ধানি জমি রংজমা দিছি। লোকসান দিয়া ধান বিক্রি করছি। এইবার জমি কেউ রংজমা নিতাছে না। আমার এখন কানবার (কান্না করা) মনে কইতাছে। যে লোকসানে ধান বিক্রি করছি, আমার যদি টেকা (টাকা) থাকতো তাহলে সব ধান গাংঙ্গ (নদীতে) নিয়া ফেলাইতাম।
ধর্মপাশা উপজেলার গোলকপুর (বেড়ির কান্দা) গ্রামের বাসিন্দা মো. মিলন মিয়া বলেন, আমি প্রতিবছর হাসকার হাওরে ৩০ কেয়ার জমিতে ধান চাষ করি। আমার নিজের আছে ১০ কেয়ার। আর ২০ কেয়ার জমি রংজমা নিতাম। গত বছরে লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। তাই এবার শুধু নিজে খাওয়ার জন্য চাষ করবো। রংজমা নিয়ে চাষ করবো না।
জামালগঞ্জের বাসিন্দা মো. এরশাদ আলী বলেন, আমার ৩ হাল (৩৬ কেয়ার) জমি ছিলো। মাইর খাইতে খাইতে (লোকসান দিতে দিতে) সর্বহারা এখন। এক মণ ধান বেইচ্ছা বাজারে চা খাইলেই শেষ হয়ে যায়। সব জমি বিক্রি কইরা এখন মাত্র ৭ কিয়ার আছে।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, সুনামগঞ্জের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হলে উৎপাদিত ধানের অর্ধেক ন্যায্য মূল্যে সরকারকেই কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে গুদাম না থাকলে কৃষকের গোলায় ধান রেখে যতটুকু বিক্রি করতে চায় সে পরিমাণে টাকা তাঁকে দিয়ে দেবে সরকার। সরকারের যখন প্রয়োজন গোলা থেকে ধান নিয়ে আসবে। তাহলে আমার জেলায় কৃষি ও কৃষক রক্ষা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন বলেন, কৃষকরা ধানের দাম না পেয়ে ধান চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছে সেটা আমরা দেখছি। কিন্তু ভাটি এলাকা সুনামগঞ্জে ধান চাষের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকার উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ৭০% ভর্তুকিতে কৃষি যন্ত্রপাতি দেয়া হবে।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তা জাকারিয়া মোস্তফা বলেন, জেলায় ধান গুদামজাত করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়াতে হবে। না হয় কৃষকরা উৎপাদন করে লাভবান হবে না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার বাইরে কিছুই করার ক্ষমতা নেই আমাদের।
admin
৬:৫২ অপরাহ্ণ