হাওরে হরিলুট!

৪ কিলোমিটারে বরাদ্দ বেড়েছে ৬ কোটি

শহীদনূর আহমেদ, :: ২০১৭ সালের কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ি পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীন সুনাগঞ্জে চলমান রয়েছে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ। বাঁধ নির্মাণ কাজের শুরু থেকেই গত বছরের চেয়ে অধিক প্রকল্প গ্রহণ, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, অক্ষত বাঁধে অধিক বরাদ্দ, পিআইসি গঠনে নীতিমালা না মানাসহ নানা অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । অভিযোগ রয়েছে অনিয়মের কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হওয়ার।

জেলার সর্বাধিক হাওরের উপজেলা শাল্লায় গত বছর ১১৫টি প্রকল্পে ১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকায় ৯২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। এবার ১৩৭টি পিআইসি’র মাধ্যমে ২৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নিমাণ কাজ চলমান রয়েছে। গত বছরের চেয়ে ২২টি বেশি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে উপজেলার বিভিন্ন হাওরে। বাঁধের পরিমাণ গত বছরের চেয়ে মাত্র ৪ কিলোমিটার বাড়লেও টাকা বেড়েছে ৬ কোটি। এই বরাদ্দ কাজের অনুপাতে অতিরিক্ত এবং বাস্তব সম্মত নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট হাওর পাড়ের কৃষকরা। গত বছরের অক্ষত বাঁধে পুনরায় প্রকল্প গ্রহণ ও অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প অনুমোদর করে এইভাবে টাকা বাড়িয়ে বাঁধ নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। ফলে সরকারের বিপুল পরিমান টাকা গচ্ছা যাচ্ছে দাবি হাওর পাড়ের সচেতন মহলের।

এছাড়াও পিআইসি গঠনে কৃষকদের পরিবর্তে অকৃষক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করে বাঁধ নির্মাণ কাজ করায় ব্যাপক পরিমাণ লুটপাটের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকরা। বাঁধের গুড়া থেকে মাটি উত্তোলন, অক্ষত বাঁধে চিলাছাচা করা, কাদা ও বালি মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ, দুরমুজ না করা, সঠিক ভাবে স্লোভ না দেয়াসহ বাঁধ কাজে নানা অসংগতির কারণে বাঁধ টেকসই না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট হাওরের উৎপাদিত বোরো ফসলের সুরক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষক কুল। সঠিক তদারকি ও নীতিমালা অনুযায়ি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করার তাগাদা জানিয়েছেন হাওর পাড়ের কৃষক ও হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।

সোমবার (৩ফেব্রুয়ারি) সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন হাওরের চলমান বাঁধ নির্মাণ কাজের অনিয়ম ও অসংগতির হালচিত্র। ছায়ার হাওর উপ-প্রকল্পের ৯০নং পিআইসি’র মাধ্যমে ২১লাখ ৩৪হাজার টাকা ব্যয়ে মাত্র ১১১মিটার দৈর্ঘ্য বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। স্বল্প পরিমাণ বাঁধ নির্মাণে এমন অতিরিক্ত বরাদ্দে নানা প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় কৃষকরা। এছাড়াও বাঁধের গুড়া থেকে কাদা মাটি তুলে গুরুত্বপূর্ণ এই বাঁধটি নির্মাণ করা হচ্ছে। যার ফলে বাঁধের স্থায়ীত্ব নিয়ে শংকা প্রকাশ করছেন অনেকেই। অভিযোগ রয়েছে এই প্রকল্পের পিআইসি সভাপতি চয়ন কান্তি চৌধুরী স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অন্যতম সহযোগি হওয়ায় ইচ্ছা মতো কাজ করছেন তিনি। এই পিঅইসি’র ন্যায় উপজেলার বেশীরভাগ প্রকল্পই নিজের আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে বাগিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় ওই জনপ্রতিনিধি বলে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনি”ছুক একাধিক স্থানীয় কৃষক।

৯০নং পিআইসি’র সংলগ্ন দাড়াইন নদীর তীরে ৮৯, ৮৮, ৮৭, ৮৬ ও ৮৫নং প্রকল্প সমূহে গত বছরে বেড়িবাঁধ তুলনামূলক অক্ষত থাকলেও পুনরায় নতুন ভাবে প্রকল্প গ্রহণ করে অধিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এইসব প্রকল্পে গড়ে ১৪-১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করনে না এলাকার কৃষকগণ। এইসব প্রকল্পে দূরবর্তী স্থান থেকে ড্রাম-ট্রাকের মাধ্যমে মাটি ফেলার কথা থাকলেও এক্সেভেটরের মাধ্যমে বাঁধের গুড়া থেকে নাম মাত্র মাটি ফেলে অক্ষত বাঁধকে মাটিচাপা দিয়ে বরাদ্দকৃত টাকা হজম করছেন সংশ্লিষ্ট পিআইসিরা। এদিকে উপজেলার উদগলবিল হাওর উপ-প্রকল্পের ৩৩ ও ৩৪নং পিআইসি’তে গত বছরের বেড়িবাঁধ দৃশ্যমান থাকলেও কোনো কারণ ছাড়াই এই দু’টি প্রকল্প গ্রহণ করে অধিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই দু’টি বাঁধকে অপ্রয়োজনীয় বলছেন এলাকার লোকজন। অপরদিকে সরজমিন ঘুরে দেখা যায় ছায়ার হাওরের ৯৮নং পিআইসি’র মাধ্যমে যে বাঁধটি নির্মাণ করা হচ্ছা তার কোনো প্রয়োজন নেই বলেও জানা যায়। কেননা, বাঁধের এক পাশে উচু করবস্থান ও অপর পাশে সাব-মার্জিবল রাস্তা রয়েছে। অতীতে কোনো সময় এই দুই স্থান দিয়ে হাওরে পানি ঢুকে নাই বলে জানান এলাকাবাসী। এছাড়াও উপজেলার কুশিয়ারা নদীর ডানতীরে ৫৪ ও ৫৪(ক) এবং ভান্ডাবিল হাওরের ১৭, ২৭ ও ২৯নং পিআইসি’র বাঁধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন উপজেলার সচেতন মহল। এর মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। অভিলম্বে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করাসহ সঠিক তদারকির মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ সম্পন্ন করার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের শাল্লা উপজেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তরুন কান্তি দাস বলেন, পিআইসি অনুমোদনের পর থেকেই আমরা প্রকল্প যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দিচ্ছি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করে নীতিমালা অনুসারে কাজ করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি জানিয়ে আসছি। যদি কারো গাফলতিতে হাওরের ফসলহানি হয় তাহলে আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী নানা কর্মসূচি’র মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

সংশ্লিষ্ট উপজেলার পওর বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল কাইয়ূমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে পিআইসি গঠন ও বরাদ্দ প্রদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পওর বিভাগের কারিগরী টীমের মাধ্যমে উপজেলার অনুমোদিত প্রকল্প সমূহে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। দু’এক দিনের মধ্যেই আমার রির্পোট পেয়ে যাবো। বাঁধ নির্মাণ কাজের অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করার জন্য সকল পিআইসি’কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন মনিটরিং টীমের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক কাজ তদারকি করা হচ্ছে। যারা নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করবে না, তাদের বিল কর্তন করা হবে।