অনেক বাঁধে ফাটল দেখা দেয়ায় ঝুঁকিতে হাওরের ফসল! আতংকে কৃষককূল

কাউসার চৌধুরী
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ও অতিবৃষ্টির ফলে নজরখালি বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর এবার শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর,ভরাম হাওর,টাংনীর হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। জেলার সকল হাওর কমবেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরই মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে নদ-নদীর পানিও। বাঁধের ফাটল দ্রুত বন্ধ করা না হলে হাওরের ফসল যেকোনো সময় তলিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এ অবস্থায় সুনামগঞ্জের কৃষকরা তাদের একমাত্র ইরি বোরো ফসল নিয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছেন। এদিকে, বাঁধ ভেঙে ফসলডুবির ঘটনায় হাওর বাঁচাও আন্দোলন গতকাল রোববার দুপুরে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।

জানতে চাইলে বাঁধ নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গতকাল রোববার রাতে  জানান, মেঘালয় থেকে পানি নেমে এসে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নজরখালি বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি প্রবেশ করেছে। অন্যান্য হাওরগুলো এখনো ভালো আছে। জেলার সকল ইউএনও’কে হাওরের বাঁধের প্রতি সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যে সকল বাঁধে ইতোমধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে-ওই ফাটলগুলো দ্রুত ভরাট করে বাঁধকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। গতকাল রোববার পানি কিছুটা কমেছে। আগামীকাল মঙ্গলবার বৃষ্টি হতে পারে। সামান্য বা মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হলে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু, অতিবৃষ্টি হলে হাওরের ফসল ঝুঁকিতে পড়বে। হাওরের ফসল রক্ষার জন্যে প্রশাসন দিনরাত বিরামহীন কাজ করে চলছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি বাঁধ ভেঙে সাথে সাথে হাওরের প্রায় ১০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে,নজরখালি বাঁধটি ফসল রক্ষার বাঁধ নয়। সেখানকার গ্রামবাসীর অনুরোধে বাঁধটি নির্মাণ করে দেয়া হয়েছিল। ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধটি নদীতে পানির তীব্রতার আগেই ভেঙে যাওয়ায় কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ সংলগ্ন কয়েকটি ছোট ছোট হাওরের অন্ততঃ ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রায়হান কবির জানান, এটি মূলত ফসল রক্ষার বাঁধ নয়। আমি এ গ্রামে এসেছি। আর এই বাঁধটি মূলত গ্রামবাসীর অনুরোধে করা হয়েছে বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে। মূলত এটি ফসল রক্ষা বাঁধ নয়। এদিকে, পানি প্রবেশ করায় নদীর পানির চাপ কমবে। অন্য হাওরের দিকে আর যাবে না। মাটিয়ান হাওর, শনির হাওরসহ সবকটি বাঁধের দিকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। ফসল রক্ষার জন্যে তারা দিনরাত কাজ করছেন বলে জানান তিনি।

দিরাই উপজেলার সর্ববৃহৎ ভরাম হাওরের তুফানখালী বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। কেবল ফাটলই নয়, বাঁধের কিছু অংশ দেবে গেছে। গতকাল রোববার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাঁধটি পরিদর্শন করেন। বাঁধের ফাটল সংস্কারে কাজও শুরু হয়েছে। তুফানখালি বাঁধটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। বাঁধটি কয়েকবার ভেঙে ভরাম হাওরে পানি প্রবেশ করেছিল বলে স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন। একই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের টাঙ্গুয়ার হাওর উপ-প্রকল্পের মিলনগঞ্জ বাজারের অদূরে বাঁধটির একটি অংশে ধস দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঁধের ধসে পড়া জায়গার ছবি ছড়িয়ে পড়েছে।

দিরাই উপজেলার ইউএনও মাহমুদুর রহমান মামুন গতরাত ১০ টায় জানান, আমি এখনো তুফানখালি বাঁধে আছি। বাঁধের ফাটল বন্ধ করে বাঁধকে শক্তিশালী করতে আমরা হেমারিং করব। পাউবো’র উর্ধ্বতন প্রকৌশলীরা বাঁধটি সরেজমিনে এসে দেখে গেছেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী হেমারিং করা হচ্ছে। পিআইসির প্রতি ভরসা না করে বাঁধ রক্ষায় আমরা নিজেরাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। এছাড়াও জায়গামতো বাঁধ নির্মাণ না করায় শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের কোনারবন্দ, জুয়ারিয়া, কৈয়ারবন্দ ও পুটিয়ারবন্দের প্রায় ৯০০ একর জমির ফসল অকাল বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছে।ওইসব ছোট ছোট হাওরে উপজেলার রঘুনাথপুর, ঘুঙ্গিয়ারগাঁও, সুখলাইন, কলাকান্দি, কান্দিখলা, ডুমরা, উজান ও ভাটি যাত্রাপুরের প্রায় চার হাজার কৃষক জমি চাষ করেছেন। ওই এলাকার জমির ফসল রক্ষায় দাড়াইন নদীর তীরবর্তী রঘুনাথপুর সারিগাছা ও কৈয়াবন্দ ভাঙনে ২ বছর আগেও পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু গেল ২ বছর এই ভাঙনের জন্য কোন প্রকল্প গ্রহণ করেনি পাউবো। পাউবো’র খামখেয়ালিপনায় ওই এলাকার ফসল নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শতভাগ সম্পন্নের কথা ছিল। কিন্তু শতভাগ কাজ শেষ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের পর আরও ১০ দিন বৃদ্ধি করেও কোনো কাজ হয়নি। বাঁধের কাজের টাকা দিতে প্রায় একমাস বিলম্ব করে পাউবো। টাকা বিলম্বে দেয়ায় কাজও অনেক বিলম্বে সম্পন্ন হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।এর ফলে অনেক বাঁধ এখনো দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। সময় মতো টাকা দেয়া সম্ভব হলে গেল বছরের মতো এবারও বাঁধ শক্ত হতো বলে একাধিক পিআইসির লোকজন জানান।

পাউবোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরে জেলার বৃহৎ ৩৬টিসহ মোট ১৫৪ টি হাওরের ফসল রক্ষায় ৫২০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করছে পাউবো।৭২২ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসি’র মাধ্যমে জেলার ১১ টি উপজেলায় বাঁধের কাজ শুরু হয়। এজন্যে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ চাওয়া হয় ১২২ কোটি টাকা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ইরি বোরো ধানের চাষাবাদ করা হয়েছে।