হাওরের ঢেউয়ে বিপন্ন হাওরবাসীর জীবন

 

 

 

গোলাম সরোয়ার লিটন

বাতাসে হাওরের পানিতে সৃষ্ট হচ্ছে বিশাল বিশাল টেউ। আর এ ঢেউ আছড়ে পড়ছে হাওরপাড়ের গ্রামের বসতভিটায়। ভরা বর্ষার কারণে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির কানায় কানায় পানি। কিন্তু পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গতকাল শনিবার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার দুই শতাধিক গ্রামের ভেতর পানি ঢুকে পড়েছে। এ অবস্থায় বাতাসে সৃষ্ট ঢেউয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলাসহ জেলার হাওরপাড়ের গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন। করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ হাওরপাড়ের বাসিন্দারা এখন সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছেন ঢেউয়ের কবল থেকে বসত বাড়ি রক্ষায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওরপাড়ের একেকটি গ্রাম সাধারণত প্রস্থে একশত ফুট এবং দের্ঘ্যে এক হাজার থেকে দেড় হাজার ফুট হয়ে থাকে। বর্ষায় জেলার এ সকল হাজারো গ্রামের চারপাশ গভীর পানিতে নিমজ্জিত থাকে। বিশাল হাওরের পাড়ে গড়ে ওঠা প্রতিটি গ্রাম দুর থেকে মনে হয় পানির ওপর ভাসমান একটি নৌকা। বিরুপ আবহাওয়ায় এ সকল গ্রাম যেন ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাবে।
সরেজমিনে গতকাল রাত ও আজ শনিবার তাহিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় লোকজন রাতভর পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে ঢেউ থেকে বসতভিটে রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। অধিকাংশ গ্রামের লোকজই নিজ বাড়ি ছেড়ে গ্রামের তুলনামুলক উঁচু বাড়িগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ঢেউ থেকে বসতভিটে রক্ষায় তারা বৃষ্টিতে ভিজে বাঁশ খুুটা , বস্তা ও হাওরের বন নিয়ে লড়াই করছেন।

 

টাংগুয়ার হাওর কেন্দ্রীয় সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহমেদ কবির বলেন, টাংগুয়ার হাওরপাড়ের ৭০ টি গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বসত ভিটে ঢেউয়ের কারণে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। লোকজন প্রাণপণ চেষ্টা করছে বসত ভিটে রক্ষার। কিন্তু প্রয়োজনীয় উপকরণের (বাঁশ ও বন) অভাব ও অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লড়াই করতে পারছেনা তারা। তিনি আরো বলেন, এই মুহুর্তে আমি (আহমেদ কবির) পরিবার নিয়ে টাংগুয়ার হাওরপাড়ের জয়পুর গ্রামে এক উঁচু বাড়িতে মাচা তৈরী করে সেখানে বসে আছি। হাওরপাড়ের অধিকাংশ পরিবার এমনভাবেই আছে। আজ ( গতকাল শনিবার) যদি বাতাস হয় তবে ঢেউয়ের কবলে পড়ে টাংগুয়ার হাওরপাড়ের ৫০টি গ্রামের লোকজন গ্রামছাড়া হব
উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের মন্দিয়াতা গ্রামের বাসিন্দা ও মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সানজু মিয়া বলেন, মন্দিয়াতা কান্দাহাটি গ্রামের অধিকাংশ বসতভিটে হাওরের ঢেউ এ ভেঙ্গে পড়েছে । এ সকল পরিবারে গবাদিপশু ও সংগ্রহ করা পশুখাদ্য (খড়) পানিতে ডুবেছে। বাধ্য হয়ে গ্রামের ৬০টি পরিবারের মধ্যে ৫৮টি পরিবার তাদের গবাদিপশুসহ শুক্রবার রাতেই বাড়ি ছেড়ে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল দুপুর বারটায় উপজেলার দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের জামলাবাজ গ্রামের মকবুল মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা যায় ঘরের ভেতর পানি। পরিবারটি সারারাত চেষ্টা করেছেন মাটিয়ান হাওরের ঢেউয়ের কবল থেকে বসত ভিটে রক্ষায়। তাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে থাকা একটি খাটের উপর স্বামী স্ত্রী শুয়ে আছেন। মকবুল মিয়া বলেন, সারারাত বউ বাচ্চা নিয়ে মাটিয়ান হাওরের ঢেউয়ের সাথে লড়াই করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ঢেউয়ে বসত ভিটে ও ঘর ভেঙ্গেছে। বাধ্য হয়ে নিজের ৪ ছেলে মেয়ে আর তিনটি গরু অন্যত্র পাঠিয়েছি।

 

তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের গোবিন্দশ্রী গ্রামের জুলহাস মিয়ার ৬ মেয়ে নিয়ে ৮ জনের পরিবার। শনির হাওরের উত্তাল ঢেউ থেকে বসত ঘর রক্ষায় সবাইকে নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন দুই দিন ধরে। জুলহাস মিয়া বলেন, পেঠে ভাত দিমু না ঘর বাঁচামু জানিনা। এই মুহুর্তে মহান আল্লাহই ভরসা।
মধ্য তাহিরপুর গ্রামের মাসুদ মিয়া শনির হাওরপাড়ের তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের পাশে নিজ জমিতে ঘর করে একটি ছোট দোকান দিয়েছেন। কিন্তু ঢেউয়ের কবলে পড়ে দোকানের অর্ধেক ভিটে চলে গেছে। পরিবারের লোকজন এবং প্রতিবেশীরা চেষ্টা করেও ঢেউয়ের কবল থেকে দোকানটি রক্ষা করতে পারেননি।

 

হাওরবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, যুগ যুগ ধরে হাওরপাড়ের বাসিন্দাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল হাওরে এক ফসলী বোরো ধান উৎপাদন এবং বর্ষায় ঢেউয়ের কবল থেকে বসত বাড়ি রক্ষায় বাড়ির সামনে ঢেউরক্ষা বাঁধ দেওয়া। বৈশাখে ফসল তোলার পরই বাঁশ, খোঁটা ও বন দিয়ে বাড়ির সামনে মজবুত করে বাঁধ দেওয়া হতো। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে গ্রামবাসী বাড়ির বাঁধকে গুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কারণ ১৯৯৮ সালের বন্যার পর থেকে হাওরে দীর্ঘমেয়াদী ভরা বর্ষা হচ্ছেনা। ২০০৪ সালে বন্যা হলেও স্থায়িত্ব কম ছিল। তাছাড়া ওই বছর বন্যার সময় বাতাস ছিলনা তাই ঢেউও ছিলনা। এরপর দীর্ঘ সময় এ বছরের মতো ভরা বর্ষা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাছাড়া এ বছর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুই বার বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। আবার বন্যার পানির সাথে হাওর এলাকায় দমকা বাতাস বইছে। এ কারণে হাওরবাসী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বেশি। তাছাড়া বাড়ি বা গ্রামের সামনে বাঁধ দিতে বন ব্যবহার করা হতো। হাওরাঞ্চলে ওই সময় তা সহজেই পাওয়া যেত। কিন্তু নানামুখী ব্যবহারে অধিক সংগ্রহে এ বন এখন আর নেই। আগে ধনী কৃষকরা বাড়ির বাঁধে বোল্ডার পাথর বা চুনাপাথর ব্যবহার করতেন। এখন এসব সংগ্রহও অধিক ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এ কারণে বসতভিটের সামনে বাঁধ সঠিকভাবে না দেওয়া বা দুর্বল ঢেউরক্ষা বাঁধের কারণে সহজেই হাওরপাড়ের গ্রামগুলো ঢেউয়ের কবলে পড়ে ভাঙ্গনে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। নয়তো যুগ যুগ ধরে হাওরবাসী এই ঢেউয়ের সাথে লড়াই করেই ঠিকে ছিল। এখন সময়ের প্রয়োজনে প্রতিটি গ্রামে ঢেউরক্ষা দেয়াল নির্মাণের দাবি জোড়ালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি অজয় কুমার দে।

 

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ্মাসিন সিংহ বলেন, বাতাসে সৃষ্ট হাওরের বিশাল বিশাল ঢেউয়ে ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে উপজেলার গ্রামগুলো। তাছাড়া উপজেলার দুই শতাধিক গ্রামের ভেতর পানি ঢুকায় দুর্ভোগে পড়েছেন উপজেলাবাসী। একই সাথে গবাদিপশু নিয়েও তারা সমস্যায় পড়েছেন। প্রশাসন তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছে।