১৭ বছরেও দিরাইয়ে সুরঞ্জিতের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার শেষ হয়নি-নেতা-কর্মীরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন স্প্লিন্টারের ক্ষত ॥ নিহত ওয়াহিদের মেয়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দিশেহারা পরিবার

 

 

কাউসার চৌধুরী
ভাটির জনপদ দিরাইয়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলার বিচার দীর্ঘ ১৭ বছরেও শেষ হয়নি। আড়ালের বিষয় বের করতে বার বার মামলাটি পুন:তদন্ত করা হলেও বিচার কার্যক্রম কেবলই বিলম্বিত হচ্ছে। দীর্ঘ দিন পরেও গ্রেনেডের স্পিøন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা। ঘাতকদের বিচার না হওয়ায় তাদের হতাশারও শেষ নেই। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি এডভোকেট সরওয়ার আহমদ চৌধুরী আবদাল জানিয়েছেন, হত্যা ও বিস্ফোরণ মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। করোনার জন্যে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করা যায়নি। নতুন করে সকল সাক্ষীকে আদালতে রিকল করে আনা হবে। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। যত দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ করা যায়-এ জন্যে রাষ্ট্র পক্ষের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মামলার বর্তমান অবস্থা
আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় , গত বছরের ২২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুানালের বিচারক শাহারিয়ার কবিরের আদালতে দিরাইয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। বিএনপি নেতা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জি কে গউছ , নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুহিব্বুল্লাহ ওরফে অভি , মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল , নাজিউর রহমান ওরফে নাজু , হাফিজ সৈয়দ নাঈম আহমদ, মাজেদ ভাটসহ ১০ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত পৃথক মামলায় এ সকল আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আবারও মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

ওই ২ মামলায় কারাবন্দী আছেন লুৎফুজ্জামান বাবর। বাবরসহ কারাবন্দী আসামিদেরকে ওইদিন বেলা ১১টায় আদালতে আনা হয়। জামিনে থাকা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জি কে গউছও আদালতে হাজির হন। অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণের কথা থাকলেও করোনা মহামারির জন্য তা আর হয়নি। করোনার প্রকোপ কমার পরে সাক্ষীদেরকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে ডাকা হবে। নতুন করে সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন আদালত।

নাজুর আত্মসমর্পণে পাল্টে যায় দৃশ্যপট
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত শেষে প্রথম দফায় ২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের আমলগ্রহণকারী আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার পর ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আদালতে এসে আত্মসমর্পণ করে হুজির সদস্য নাজিউর রহমান ওরফে নাজু। যাকে ঘটনার পর হন্যে হয়ে খুঁজেছিল সিআইডি। নাজুর আত্মসমর্পণের পর মামলার দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। রাষ্ট্রপক্ষ আড়ালের ঘটনা বের করতে উদ্যোগী হন।
সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিআইডির বিশেষ টিম হাফিজ নাঈমকে বিভিন্ন বোমা হামলায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করে। এই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর ৩ নভেম্বর সুনামগঞ্জের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হাজেরা খাতুনের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় আরেক জঙ্গি হাফিজ সৈয়দ নাঈম আহমদ। জবানবন্দির সূত্র ধরে সিআইডি কর্মকর্তা জানান , নাঈম বলেছে ” আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ দিরাই আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে হত্যার উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবে হুজি’র শীর্ষ সদস্যরা এই হামলা করে। স্থানীয় একটি চক্র তাদেরকে সহযোগিতা করেছে। সৈয়দপুর মাদ্রাসার ছাত্র নাঈম আহমদ দুটি গ্রেনেড মুফতি হান্নানের কাছ থেকে এনে দেয় এবং নাজিউর রহমান ওরফে নাজুকে গ্রেনেড বিস্ফোরণের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নাজু একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে। তবে অন্যটির বিস্ফোরণ ঘটেনি। গ্রেনেড হামলার পর জঙ্গিরা কৌশলে দিরাই থেকে পালিয়ে যায়।

নাঈমের জবানবন্দিতে নাজুর নাম আসায় মামলাটি পুনরায় তদন্তের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন থাকা মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তৎকালীন স্পেশাল পিপি এডভোকেট কিশোর কুমার কর আবেদন করেন। আবেদনের শুনানিতে স্পেশাল পিপি ছাড়াও সিলেট জেলার তৎকালীন পিপি এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও সিলেটের অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট শামসুল ইসলাম অংশ নেন। শুনানি শেষে আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর সিআইডি পুনরায় তদন্ত শুরু করে।

এবার বাবর-আরিফ-গৌছের নাম
সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক সফিকুর রহমান খান তদন্ত চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে সহকারী পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি জঙ্গি নাজুকে ২০১১ সালের ১৩ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সর্বশেষ সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বাসু দত্ত চাকমা মামলার দায়িত্ব পান। তদন্তের এক পর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা বিএনপি-জামায়াত সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী , হবিগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন মেয়র জি. কে গৌছের নাম আসে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০১৬ সালে তাদেরকে এ মামলায় গ্রেফতারের পদক্ষেপ নেন।
তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের ব্যাপারে ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই সুনামগঞ্জের আদালতে শুনানি হয়। আদালত সিআইডির আবেদন মঞ্জুর করেন। ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি আরিফুল হক চৌধুরী ও জি. কে গৌছ সুনামগঞ্জ আদালতে হাজির হয়ে এ মামলায় আত্মসমর্পণ করেন। আরিফুল হক চৌধুরী ও জি. কে গৌছ তাদেরকে আসামি করার বিষয়টি সম্পূর্ণ বানোয়াট -উদ্দেশ্যমূলক বলে দাবী করেন। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা ১০ জনকে আসামি করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে মামলার প্রধান আসামি হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান , শরীফ সাহেদুল ইসলাম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর হয়। হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলার মামলায় তিন জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ। এ জন্যে মামলার অভিযোগ গঠন থেকে এই তিন জনকে বাদ দেন আদালত।

ফিরে দেখা ২১ জুন ২০০৪
২০০৪ সালের ২১শে জুন বিএনপি সরকারের আমলে ভাটির জনপদ দিরাই পৌর শহরের শ্রী শ্রী জগন্নাথ জিউর মন্দিরের সামনের ত্রিমোহনায় জনসভার আয়োজন করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন দলের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য, প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি। অকাল বন্যায় সহায় সম্বল হারানো কৃষকদের পুনর্বাসনের দাবী জানিয়ে তিনি সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে কিছু দূর যেতে না যেতেই বিকট শব্দে গ্রেনেডটি বিস্ফোরণ হয়। অল্পের জন্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রাণে রক্ষা পেলেও মুহূর্তেই রক্তে লাল হয়ে যায় জনসভাস্থল। আহতদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে দিরাই। আহতদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান দলের কর্মী আব্দুল ওয়াহিদ। তিনি উপজেলার মাতারগাঁও গ্রামের ঠাকুরধন মিয়ার পুত্র। এডভোকেট সোহেল আহমদ , সিরাজুদ্দৌলা তালুকদার, সুজাত আহমেদ চৌধুরী , নুরুল ইসলাম সর্দার , বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক , প্রভাকর চৌধুরী, আব্দুর রবসহ ২৫ হন আহত হন।
এ ঘটনায় দিরাই থানার তৎকালীন সেকেন্ড অফিসার এস.আই হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদেরকে আসামি করে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করেন। প্রথমে দিরাই থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরবর্তীতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিতে স্থানান্তর করে পুলিশ সদর দপ্তর।

ওয়াহিদের মেয়ে লড়ছে ক্যান্সারের সাথে
মাতারগাঁও গ্রামের দিন মজুর আব্দুল ওয়াহিদ পেশায় ছিলেন নৌকা চালক। ছোট্ট নৌকা স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘ডিঙ্গি নাও’ চালিয়ে পরিবারের ভরণ পোষণ করতেন। হঠাৎ করে তার মৃত্যুতে পরিবারে অন্ধকারে নেমে আসে। সম্প্রতি ওয়াহিদের মেয়ে শাহানারা বেগম (৩০) মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। কিন্তু,ব্যয় বহুল চিকিৎসা নিয়ে পরিবারটি এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। দলের নেতৃবৃন্দ ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য -সহযোগিতা করলেও এখনো তাদের ভাগ্যে আনুষ্ঠানিক কোন অনুদান জুটেনি।

বিচারের আশায় তারা
গ্রেনেড হামলায় আহতদের মধ্যে সুনামগঞ্জে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজাত আহমেদ চৌধুরী , বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম সর্দার, প্রভাকর চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক চেয়ারম্যান ও আব্দুর রব ইতোমধ্যে মারা গেছেন। গ্রেনেডের স্পিøন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন এডভোকেট সোহেল আহমদ ও সিরাজুদ্দৌলা তালুকদারসহ নেতাকর্মীরা।
এডভোকেট সোহেল আহমদ  বলেন, সেদিনের ভয়াবহ ঘটনা ভুলার নয়। আমি তো মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি। বাঁচার আশা ছিল ক্ষীণ। গ্রেনেডের স্পিøন্টার শরীরে নিয়ে কেউ কেউ মারা গেছেন। কিন্তু বিচার দেখে যেতে পারেননি। আমরা এখনো বিচারের আশায় আছি। অথচ ১৭ বছর হয়ে গেল ঘাতকদের বিচার হল না। আমরা দ্রুত বিচার কার্যক্রম সম্পন্নের দাবী জানাই।