৮  বছরে ও পূর্ণতা পায়নি দিরাই’র কালনী সেতু সাড়ে ৫ কোটি টাকার প্রকল্পের গার্ডওয়াল হেলে পড়েছে

কাউসার চৌধুরী::
দিরাইবাসীর স্বপ্নের ‘কালনী সেতু’ কেবল সংযোগ সড়কের কারণে এখনো পূর্ণতা পায়নি। সাড়ে ৫ কোটি টাকার সংযোগ সড়কের গার্ডওয়ালটি নির্মাণকালেই হেলে পড়েছে। বছরের পর বছর ধরে কাজ করলেও সংযোগ সড়কটির কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না। ৬ বছর আগে সেতুর কাজ শেষ হলেও এখনো চালু না হওয়ায় হাওরাঞ্চলের লোকজন ক্ষুব্ধ। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নিম্নমানের মালামাল দিয়ে কাজ করায় গার্ডওয়ালটি হেলে পড়েছে। ভালোভাবে খোঁজ নিলে এখানে অনিয়ম বেরিয়ে আসবে। তবে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এল.জি.ই.ডি) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম দাবি করেন, সংযোগ সড়কটির কাজ মানসম্মত হচ্ছে। হেলে পড়া গার্ডওয়াল ঠিক করে দ্রুত কাজ সম্পন্ন হবে।
এল.জি.ই.ডি সূত্রে জানা গেছে, প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একান্ত আগ্রহে দিরাইয়ে কালনী নদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এল.জি.ই.ডি। ২০১২ সালের ৩০ জুন তৎকালীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালনী সেতুর নির্মাণ কাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। এল.জি.ই.ডি.র প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ২১০ মিটার দীর্ঘ ও ৬ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থের সেতুটির নির্মাণ কাজ ২০১৫ সালে সম্পন্ন হয়। শুরুতে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় নির্ধারণ থাকলেও পরবর্তীতে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে এল.জি.ই.ডি।
সূত্রমতে, মূল সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্নের পর সংযোগ সড়ক বা এপ্রোচ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সুনামগঞ্জের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মেসার্স নুরুল ইসলাম সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ পায়। ৩৭৫ মিটার সংযোগ সড়কটির পুরো অংশই গার্ডওয়াল দিয়ে শক্তভাবে নির্মাণ করতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগে সংযোগ সড়ক নির্মাণ সম্পন্নের কথা থাকলেও এখনো শেষ হয়নি।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মূল সেতুর পশ্চিম প্রান্তে টি সাইজের সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করে মেসার্স নুরুল ইসলাম। পুরো সংযোগ সড়কটি গার্ডওয়ালের মধ্যেই নির্মাণ করার কথা। গার্ডওয়ালের মধ্যে বালু ফেলে সংযোগ সড়ক নির্মাণের এক পর্যায়ে গার্ডওয়ালটি হেলে পড়ে। পশ্চিম প্রান্তের গার্ডওয়ালটি হেলে পড়ায় ওয়ালের অভ্যন্তরে ফেলা বালু-মাটি দ্রুত সরানো শুরু করে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। মূল সেতুর টিক পশ্চিম প্রান্তের গার্ডওয়ালটিও বাঁকা হয়ে গেছে। গত কয়েক মাস ধরে সংযোগ সড়কটি ঠিক করতে গার্ডওয়ালকে পূর্বের ন্যায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। সংযোগ সড়কটির বাস্তব চিত্র গত দু’মাসে অন্তত ৪ বার প্রত্যক্ষ করেন এ প্রতিবেদক। গার্ডওয়াল হেলে পড়ায় স্থানীয়দের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে বলে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, গার্ডওয়ালটি রক্ষা করতে গত কয়েকদিন ধরে মাটি ও বালু সরিয়ে ক্র্যানের সাহায্যে দুদিকের মধ্যে রড দিয়ে টানা দেয়া হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ গার্ডওয়ালটি ঠিক রেখে সংযোগ সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ করে সেতুটি উদ্বোধন করা হবে এ ব্যাপারে স্থানীয় লোকজনের কাছে এর কোন তথ্য নেই।
জানা গেছে, কালনী সেতু নির্মাণের ফলে দিরাই উপজেলার করিমপুর, তাড়ল, জগদল ও কুলঞ্জ ইউনিয়নের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কালনী সেতু থেকে জগন্নাথপুরের কলকলিয়া পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রয়াত জননেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দিরাই ও জগন্নাথপুরের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ গড়ে তুলতেই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। দিরাইয়ের লোকজন সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে দ্রুত সেতুটি চালুর দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি  জানান, গার্ডওয়ালসহ পুরো নির্মাণ কাজে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করায় এমনটি হয়েছে। নক্শায় ত্রুটি ছিল বলেও জানান কয়েকজন। নিজেদের কার্যালয়ের ১০০ গজের মধ্যে এমন অনিয়ম হলেও স্থানীয় এল.জি.ই.ডির কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করেন। এল.জি.ই.ডি দিরাইয়ের প্রকৌশলী মোঃ ইফতেখার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কয়েক দফা তার দাপ্তরিক মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
দিরাই পৌর মেয়র বিশ্বজিৎ রায় বলেন, কালনী সেতু ছিল আমাদের নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। তিনি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। মূল সেতু নির্মাণ হলেও সংযোগ সড়ক না হওয়ায় হাওরাঞ্চলবাসী সেতুর সুফল ভোগ করতে পারছেন না। ঠিকাদারের চরম গাফিলতির কারণে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ব্যাহত হচ্ছে। কর্মকর্তাদেরও নজর দেয়া জরুরি। কোন অনিয়ম হয়েছে কিনা তাও কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তিনি দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে সেতু চালুর দাবি জানান।
সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজের ঠিকাদার নূরুল ইসলাম বলেন, আমরা কাজ প্রায় শেষ করেছিলাম। গত বন্যার সময় সড়কের উপর খাদ্য গুদামের কয়েকটি ট্রাক রেখে দেয়ায় এ সমস্যাটি হয়েছে। এখনও কাজ চলছে। গার্ডওয়ালের ভেতরে টানা দিয়ে হেলে পড়া অংশ ঠিক করা হয়েছে। আগেও টানা দেয়া হয়েছিল। দুটি গার্ডওয়ালের মধ্যে শক্ত করতে টানা দিতে হয় এটাই নিয়ম। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ীই গার্ডওয়াল তৈরি করে এর মধ্যে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ভালো মানের কাজ হয়েছে-মালামালও ভালো। এখানে অনিয়মের কোন প্রশ্নই আসে না।
সুশাসনের জন্যে নাগরিক সুজন সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়কারী ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে গার্ডওয়ালের চিত্র এসেছে। এতে স্পষ্ট দেখা যায়, গার্ডওয়ালটি হেলে পড়েছে। নিম্নমানের কাজের ফলেই এমনটি হয়েছে। বিষয়টির ব্যাপারে ভালোভাবে খোঁজ নেয়া দরকার। কারণ একটি প্রকল্পে এমনভাবে কাজ করাটাও অনিয়মের অংশ। তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়ার দাবি জানান।
এল.জি.ই.ডি সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম গতকাল বুধবার দুপুরে বলেন, সংযোগ সড়কের কাজটি মানসম্মতভাবেই হয়েছে। সমস্যা হয়েছিল। এখন কোনো সমস্যা নেই। কিছুদিনের মধ্যেই পুরো কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।