চাষাবাদ নিয়ে শঙ্খায় এবারও শতাধিক গ্রামের কৃষক

বিশেষ প্রতিনিধি
জামালগঞ্জ ও দিরাই উপজেলার বিশাল অংশ নিয়ে রয়েছে পাগনার হাওর। এই হাওরপাড়ের মানুষদের কার্তিক মাসের এই সময়েও নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াত করতে হচ্ছে। হাওরপাড়ের শতাধিক গ্রামের মানুষ আগামী মৌসুমের বোরো চাষাবাদ নিয়ে শঙ্খার মধ্যে রয়েছেন। গত প্রায় ২২ বছর ধরে এসব গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে নিজেদের জমি চাষাবাদ করতে সমস্যায় ভুগছেন। এবারও এই সংকট থাকতে পারে বলে আশংকা করছেন হাওরপাড়ের শতাধিক গ্রামের কৃষক।
জেলার বৃহৎ হাওরগুলোর অন্যতম পাগনার হাওর। হাওরে জমি রয়েছে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর। ১৫ হাজার কৃষক পরিবারের জীবন জীবিকা এই হাওরের ফসলের উপর নির্ভরশীল। গত প্রায় ২০ বছর ধরে পলিমাটি পড়তে পড়তে হাওরের অভ্যন্তরের কানাইখালি খাল ভরাট হয়ে গেছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাওয়ারপাম্প কাজে লাগিয়ে হাওরের অর্ধেকেরও বেশি জমি আবাদ করেছেন কৃষকরা। গেল তিন বছর হয় জলাবদ্ধতা বেশি হওয়ায় হাওরের অর্ধেকেরও বেশি জমি অনাবাদী থাকছে।
দক্ষিণে নেত্রকোনার কালিয়াজুরির চাকুয়া ও দিরাইয়ের রফিনগর ইউনিয়ন, উত্তরে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ সদর উত্তর, পুর্বে ভীমখালী এবং পশ্চিমে ফেনারবাক ইউনিয়ন নিয়ে পাগনার হাওর। বৃহৎ এই হাওরের ভেতরে ছয়হারা ভান্ডা বিল, ভান্ডা মল্লিকপুর, রাজাবাজ, কুরাইল্লার, বিনাজুরা, দিরাই বিল, ছয়হারা পিঠাইল্লা, বাঘেরকোণা, ডাবাছোড়া. গজারিয়া, ধনারকোণাসহ অসংখ্য ছোট ছোট বিল ও হাওর রয়েছে। হাওরের বেশিরভাগ জমি ফেনারবাক ইউনিয়নের কৃষকদের। অন্য ইউনিয়নগুলোর কৃষকদেরও জমি রয়েছে।
পাগনার হাওরপাড়ের উজান দৌলতপুর গ্রামের কৃষক মুক্তিযোদ্ধা কবিন্দ্র কুমার সরকার বললেন, জেলার অন্যান্য হাওরপাড়ে বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। পাগনার হাওরপাড়ের কৃষকরা অগ্রহায়ণ মাসেও বীজতলা তৈরি করতে পারবেন কী-না বুঝতে পারছেন না। এখনো বীজতলায় কোমর সমান পানি। বীজতলায় বীজ বপন করার পর ধানের চারা হবে, পরে চারা নিয়ে জমিতে রোয়া দিতে হবে। হাওরে যে পরিমান পানি ঠিক সময়ে রোয়া দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
হাওরপাড়ের কামারগাঁও গ্রামের রাধা কান্ত সরকার বলেন,‘রোয়া দিতে বিলম্ব ধান পাকাও পিছিয়ে যায়, একারণে ফসল বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্খাও থেকে যায়।’
পাগনার হাওরপাড়ের গজারিয়া গ্রামের খলিলুর রহমান বলেন,‘হাওরের পানি নামবে কী-না, এখনো বলা যাচ্ছে না। পানি কী পরিমাণে নিস্কাশন হবে, আরও কয়েকদিন না গেলে বুঝা যাবে না।’
হাওরপাড়ের ছয়হারা গ্রামের রাজেন্দ্র তালুকদার বললেন, পুরো ভাটি এলাকার কোনো হাওরেই এই সময়ে এতো পানি নেই। পানি নিস্কাশনের সমস্যা থাকায় এখনো হাওরের এপাশ থেকে ওপাশ, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ট্রলারে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
ফেনারবাক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু তালুকদার জানালেন,‘বোরা চাষাবাদের চারা বপনের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু পানি দ্রুত না নামলে, এই চারা রোপন করা যাবে না। চারার বয়স বেশি হয়ে গেলে অনেক সময় গাছে ধান আসে না। তার মতে পিয়াইন নদীর দিরাইয়ের রফিনগর ইউনিয়নের একটি অংশ, নেত্রকোণার কালিয়াজুরি’র বল্লি ইউনিয়নের একটি অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এই অংশগুলো খনন না হলে পানি নামবে না। হটামারা গ্রামের সম্মুখের অংশ থেকে দিরাইয়ের বাংলাবাজার পর্যন্ত পিয়াইন নদীর পাড়ের চেয়ে হাওর নীচু হয়ে গেছে। কানাইখালি নদী খনন না করলে এই সমস্যা থেকে হাওরকে রক্ষা করা যাবে না। তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট সকলকেই আমি এই বিষয়ে জানিয়ে আসছি।
সুনামগঞ্জ পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন,‘পাগনার হাওরের পানি নিস্কাশনের ব্যাপারে আমরা খুবই আন্তরিক। এই হাওরের পানি নামানোর জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী, উপজেলা সার্ভেয়ারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে তারা সরেজমিনে হাওরে ঘুরে কানাইখালী নদী ও সংযুক্তখাল কোন দিকে খনন করা লাগবে চিহিৃত করে দেবার কাজ করবেন। এই হাওরের পানি নিস্কাশনের জন্য জন্য ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে পাঠানোর চিন্তা করছি আমরা। এই বছরের পানি নামানোর জন্য যেখানে প্রতিবন্ধকতা দেখা যাবে, সেখানেই খনন করে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।