বিশেষ প্রতিনিধি
সরকার ধানের দাম বাড়ালেও সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি নেই। হাওরপাড়ের একাধিক কৃষক বলেন,‘ধানের দাম বাড়ালেই আমরার কী লাভ, ধানতো আমরা গোদামে দিতে পারি না, দেয় চেয়ারম্যান সাবের আত্মীয়-স্বজনে, না হয় ধানের ব্যবসায়ী বা ফড়িয়া টাউটরা’।
প্রান্তিক কৃষকদের ধান চাষে উৎসাহিত করতে এবার সরকার ধান-চালের দাম বাড়িয়েছে। সোমবার খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন প্রতি কেজি ধান ২৩ টাকা এবং প্রতি কেজি চাল ৩২ টাকা করে এবার কিনবে সরকার।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের অনেকে খুশি হলেও, হতাশার কথাই ব্যক্ত করলেন তারা।
জামালগঞ্জের পাকনার হাওরপাড়ের উজান দৌলতপুরের কৃষক বিপ্লব তালুকদার বলেন,‘সরকার ধানের দাম বাড়াইলেও আমরা লাভ নাই, আমরা সরকারি গোদামে ধান দিতে গেলে কয় শুকাইছে না, আদ্রতা কম, আবার ই-ধানঔ আমরার কাছ থাকি কম দামে কিইন্না অন্যরা গোদামে দিতে পারে’।
দিরাই উপজেলার বরাম হাওর পাড়ের উজানধলের কৃষক ইদ্রিছ আলী বলেন,‘ধানের দাম বাড়াইলেই আমরার কিতা (কী হয়), কমাইলেই কিতা, আমরার পাঁচ-সাড়ে পাঁচ’শ টাকা মণেই ধান বেচা লাগবো, আমরার ধান তো সরকারে নিত নায়’।
কৃষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অবনী মোহন দাস বলেন,‘শাল্লায় এবার ৬০ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষকদের মুখে হাসি নেই, এর মধ্যে সরকার ধানের দাম বাড়ানোয় কৃষকরা কিছুটা স্বস্থি পেয়েছেন, তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা খাদ্য গোদামে যেতে পারে না, টাউট-বাটপাররা খাদ্য গোদাম কর্মকর্তার যোগসাজসে গোদামে ধান দেয়। নানা অজুহাতে কৃষকদের সরকারি ক্রয় কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কাঁচা ধান, আদ্রতা কম ইত্যাদি বলে বার বার ঘুরানো হয়, পরে এসব কৃষকদের ধানই টাউটরা কম দামে কিনে গোদামে সরবরাহ করে, প্রান্তিক কৃষকরা ধানের মূল্য না পাওয়ায় সরকারের উদ্দেশ্যেও বাস্তবায়ন হয় না’।
অবনী মোহন দাস বলেন,‘উপজেলায় ধান ক্রয় কমিটি থাকলেও এমন অন্যায় কাজ ঠেকানোর জন্য জেলা প্রশাসনের তত্বাবধানে একটি আলাদা মনিটরিং কমিটি হতে পারে, যারা সকল চাপ মোকাবেলা করেও প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষেই ভূমিকা রাখবেন’।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমা-ার ইউসুফ আল আজাদ বলেন,‘জামালগঞ্জ খাদ্য গোদামে দুলাল মিয়া, মুকিত চৌধুরী, মুখলেছ মিয়া, আলী হোসেন, নুপুর গণি-ই সাধারণত ধান বিক্রি করেন। অন্যরা (কৃষকরা) দিতে গেলে বলা হয় ধান পাকে নি, আদ্রতা কম, পরে কৃষকরা বাধ্য হয়ে যারা ধান গোদামে দিতে পারে তাদের কাছেই বিক্রি করে’। তিনি জানালেন, ইউপি চেয়ারম্যানরা প্রকৃত কৃষকের তালিকা দিলে এবং সে অনুযায়ি ধান ক্রয় হলে প্রান্তিক কৃষকরা ধান দিতে পারে।
কৃষক সগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক, ধর্মপাশার কৃষক খায়রুল বাশার ঠাকুর খান বলেন,‘ইউপি চেয়ারম্যানরা কৃষকের তালিকা করেন এবং টুকেন দেন। ধর্মপাশায় এই টুকেনে একজন কৃষক ৭০ মণ ধান সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে দেবার কথা, কিন্তু এসব টুকেন চেয়ারম্যানদের আত্মীয়-স্বজন বা পছন্দের কয়েকজন পায় এবং এরাই বিভিন্ন নামে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রভাবে টুকেন বিলি হয়। অর্থাৎ টুকেন দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, এসব কারণে প্রান্তিক কৃষকরা বঞ্চিত হন এবং সরকারের উদ্দেশ্য পূরণ হয় না’।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক জাহিদুল হক বলেন,‘জেলায় এবার ৮ লাখ ৬ হাজার মে.টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, প্রাকৃতির দুর্যোগের কারণে কাঙ্খিত অর্জন হবে না। সরকার ধান চালের দাম বাড়িয়েছেন, কৃষকরা সেই দামে বিক্রি করতে পারলে, তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে’।
জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন,‘সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে যাতে কৃষকরাই ধান দিতে পারেন, মধ্যস্বত¦ভোগিরা যাতে সুযোগ না দিতে পারে, সে বিষয়ে এবার সুনামগঞ্জের প্রত্যেকটি ক্রয় কেন্দ্রকে সতর্ক করে দেওয়া হবে’।
admin
১১:৩১ পূর্বাহ্ণ