কে শুনে অসহায় জহুরার কথা?

নিজস্ব প্রতিবেদক: জহুরা বিবি। বয়স ৬০। তিন মেয়ে নিয়ে সংসার। কিন্তু মেয়েদেরকে বিয়ে দিলেও ভাগ্যের কাছে হারতে হয় জহুরাকে। কপাল মন্দের কারনেই মেয়েদের স্বামী থাকা সত্ত্বেও মায়ের কাছেই থাকতে হচ্ছে। একদিকে তিন মেয়ে অন্য দিকে নিজের স্বামীর কর্মহীনতার কারনে অসহায়ত্ব জীবন যাপন করতে হচ্ছে জহুরাকে। তবে জানা যায়, সাংসারিক অভাব-অনটনের কারণে অনেক আগেই জহুরা বিবির স্বামী সওদাগর মিয়া পৈতৃক ভিটিটুকু বিক্রি করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। সম্পর্ক নেই তার স্ত্রী ও কন্যাসহ নাতি-নাতনীদের সাথে। ওই পরিবারটির আদি নিবাস ছিল সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার ৪নং শাল্লা ইউপি’র চব্বিশা গ্রামে। জহুরা বিবি’র বাবার বাড়ি একই ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী কান্দিগাঁও গ্রামে। পিতার নাম মৃত জয়ধর আলী।

জহুরা বিবি এ পরিণত বয়সে স্বামী পরিত্যাক্তা দুই মেয়ে ও তিন নাতি-নাতনীকে নিয়ে লতা-পাতার ছাউনি বানিয়ে প্রায় ৬ বছর ধরে বাস করছেন কান্দিগাঁও মৌজার সরকারি খাস ভূমিতে। যা ওই উপজেলার ৩নং বাহাড়া ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান রবীন্দ্র চন্দ্র বৈষ্ণবের ভেড়াডহর গ্রামে তার সমাধি থেকে মাত্র পঞ্চাশ মিটার পশ্চিম দিকে। চারপাশে নেই কোনো ঘর-বাড়ি। যোগাযোগের নেই রাস্তা। একা একাই বাস করছে জহুরা’র পরিবার। জহুরা’র তৈরী লতা-পাতার কুঠিরে প্রবেশ করে রান্নার দু’চারটি বাসনপত্র ছাড়া অন্যকোনো জিনিষপত্র দেখা যায়নি তার ঘরে। ডিসেম্বরের এই শীতে কাবু হয়ে থাকেন তিনি। নেই শীতবস্ত্র। পরনের একমাত্র কাপড়েই চলছে তার জীবন।
গত একদিন পূর্বে কোনো একজনের ফেসবুক ওয়ালে দেখা যায় ছবিটি। আর সেই থেকে জহুরা বিবির খোঁজে চলা। প্রায় সারাদিন খোঁজতে-খোঁজতে অবশেষে বিকাল সাড়ে চারটার মধ্যে পাওয়া যায় তার অবস্থান। দেখা হয় জহুরা বিবি’র সাথে।
আপনি কি সওদারগর মিয়ার স্ত্রী জহুরা বিবি ? জানতে চাইলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। কেঁদে কেঁদে বলেন, আমি জহুরা বিবি, আমি এখানে মেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে ছয় বছর ধরে আছি। তিনি বলেন, আমার ঘর, স্বামী, সংসার সবই ছিল। কিন্তু আমার নসিব খারাপ। স্বামী থেকেও নাই। একটা ছেলেও নাই। কেউ আমার খবর রাখে না। মেয়ে তিনটাকে বিয়া দিছিলাম। একটা মেয়ে স্বামীর বাড়ি আছে। বাকি দুইটা বাধ্য হয়ে আমার কাছেই থাকে। তারা এলাকার মাইনষের বাড়িতে কাম-কাজ করে চলে। তিনি আরো জানান, আমি এরকম অবস্থায় আছি, এরপরও চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাই না। তারা আমাকে বয়স্কভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ কিচ্ছু দেয়না। আমি চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে গেলে দুর-দুর করে দেয়। আমি আর কেউর কাছে যাই না। মাইনষের ক্ষেতে-খামারে কাজ করি আর লতা-পাতা দিয়া খাইয়া ঘুমাইয়া থাকি।
সরকার ‘ভূমিহীন ও গৃহহীণ’ লোকদের ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। আপনি সরকারি জায়গায় থাকেন। ঘরের জন্য আবেদন করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি কার কাছে আবেদন করবো। কে আমারে সরকারি ঘর দিবো। আমার কিচ্ছু দরকার নাই। এই দেশে আমার কেউ নাই কথাগুলো বলতে বলতে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
জহুরা বিবি’র সাথে কথা বলে ফেরার পথে প্রতাপপুর বাজারে কথা হয় একই ইউনিয়নের নাছিরপুর গ্রামের শাহাব উদ্দিন ও আজিজুল হকের সাথে। তারা বলেন, সত্যিই ওই মহিলা নিতান্ত খারাপ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। গত বর্ষায় যখন বন্যা হয়েছিল তখন আমরা দেখেছি জহুরা’র ছোট ছোট দু’জন নাতি গাছের ডালে বসে দিন কাটাতো। ওইসময়ও জহুরা সরকারি কোনা সহযোগিতা পায়নি। তারা আরো বলেন, সরকারের উচিৎ ওই মহিলাকে ও তার পরিবারকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা।
এদিকে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা সকলের আশ্রয়ণ নিশ্চিত করতে সারাদেশে ‘আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এশাল্লা উপজেলায় এরই মধ্যে ‘ভূমিহীন ও গৃহহীণ’দের আবাসন নিশ্চিতে ১৬০ ঘর নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন চলছে এবং আরো ১হাজার ৪শ’ ঘর নির্মাণের জন্য সুবিধাভোগীর তালিকা তৈরী করা হচ্ছে। কিন্তু উপজেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়নে প্রকাশিত সুবিধাভোগীর খসড়া তালিকায় ওই জহুরা বিবি’র নাম দেখা যায়নি।